#জীবন দর্পন# গল্পগ্রন্থ

February 28, 2025
“জীবন দর্পন”
মুহা, মোশাররফ হোসেন
লেখক পরিচিতিঃ
মুহাঃ মোশাররফ হোসেন ১৯৮২ খৃষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর, বাংলা ১৩৮৯ সালের ১৫ই অগ্রহায়ন রোজ বুধবার যশোর জেলার মনিরামপুর থানার অন্তর্গত ঝাঁপা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাহার পিতা মৌলভী আজহারুল ইসলাম। তিনি একই গ্রামে ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসার মৌলভী শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি একাধিক বই রচনা করেন। মাতাঃ মৃতঃ গফুরুননেছা, পেশায় গৃহিনী। ৩ বোন এবং ৪ ভায়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ট। ভাইদের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট।
ঝাঁপা পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করলেও পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী পিতার কর্মস্থল ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসায় ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পরবর্তীতে কাশিপুর পীরবাড়ি সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হয় এবং ১৯৯৭ খৃষ্টাব্দে দাখিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগে পাশ করেন।
পরবর্তীতে মনিরামপুর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হলেও পিতার নির্দেশে পুনারয় ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসায় আলিমে ভর্তি হয়ে ১৯৯৯খৃষ্টাব্দে আলিম পাশ করার পর খেদাপাড়া ফাযিল মাদ্রাসায় ফাযিলে ভর্তি হলেও সংসারের দায়িত্ব কাঁধে আসায় পড়াশুনা চলমান রাখতে পারে নাই।
কর্মজীবনে পারিবারিক ব্যাবসা পরিচালনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে লেখালেখি শুরু করেন।  বর্তমানে তিনি নিউজবিডিজার্নালিস্ট২৪ (অনলাইন মিডিয়া) এর প্রকাশক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সাথে তিনি লেখা-লেখির ময়দানেও অনেকটা এগিয়ে চলেছেন।
লেখকের কথাঃ
মহান রবের দরবারে শুকরিয়া যে “জীবন দর্পন” এই’ গল্পগ্রন্থটি খুব দ্রুতই প্রকাশ পাবে ইনশাআল্লাহ।  গ্রন্থটি বাস্তব জীবনের একটি ঘটনা কল্পনায় এঁকে তা মলাট বন্দী করবার প্রয়াস মাত্র আমার। আশা করি গ্রন্থটিতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে যা পাঠক পাঠে অনুভব করতে পারবে, বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ, দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালোবাসা, মান, সম্মান, আনন্দ-বেদনা ও মধুর সময়ের ঘটনাবলী। আমি বিশ্বাস করি বইটি পড়ে পাঠকগণ মুগ্ধ হবে এবং ভালো লাগবে। আর পাঠকের ভালো লাগলে লেখকের আরো লেখার প্রতি অনুপ্রেরণা যোগাবে।
আমার ইতোপুর্বে বেশ কয়েকটি সংকলন প্রকাশ হয়েছে তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য, ‘ইতিহাসের পাতায় যশোর, “ভাগ্যের লিখন” (কাব্য গ্রন্থ), যৌথ কাব্য গ্রন্থ” শত কবিতার সমাহার, আলোর মশাল, ছুঁয়ে দাও কল্পনায়, একক গল্প “জীবন নামের খেয়া” (গল্পগ্রন্থ) আরও অনেক যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দ্বার প্রান্তে, এছাড়া যৌথগ্রন্থ “গল্পে গল্পে হারিয়ে যাবো”। এবং এককভাবে “শিক্ষনীয় তিন গল্প” ছাড়াও আরো অনেকগুলো পান্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
১ম পরিচ্ছেদঃ
গ্রামের সহজ সরল মনের মানুষ হোসাইন। তার বাবাও একেবারে সাদা মনের আদর্শবান মানুষ ছিলেন। হোসাইন ছোট বেলা থেকেই বন্ধ-বান্ধব ও স্কুল সাথিদের সাথে অমায়িক ব্যবহার ও নম্র ভদ্রতায় মিলেমিশে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। তার সরলতা ও সততার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বন্ধু-বান্ধবরা অনেক সময়ই হাসিঠাট্টা করতো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ঠাট্টা-মস্কারা করে হেনস্থা করবার চেষ্টা করতো যাতে করে হোসাইন ক্লাসে থেকে অপমানিত হয়ে রাগ করে বেরিয়ে যায়। এমন ঘটনা বহুদিন ঘটেছে। ক্লাসে বন্ধু বান্ধবদের কটাক্ষে হোসাইন অপমানিত বোধ করলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কিছুই বলতেন না। কারণ সে লেখাপড়ার প্রতি বেশ মনোযোগী ছিলো। ইচ্ছে ভালো মানুষ হওয়ার।
হোসাইনরা চার ভাই তিন বোন। বাবা ছোটখাটো একটি চাকরি করতেন। যা বেতন পেতেন তাতে সংসার চলে না। খুব অভাব অনটনের সংসার। দিন আনতে পান্তা ফুরায়! অধিকাংশ সময় ধারদেনা করে চলতে হতো। বাড়ি ছাড়া মাঠে তেমন একটা ফসলি জমি নেই। যা আছে তা দিয়ে কোনো মতে চলে। মাঝেমধ্যে চাউল কিনেও খেতে হতো। হোসাইনের বাবা মাস শেষ হলে যা বেতন পেতেন তা কোথায় কোন ঋণ আছে তা দিতে হিসেব-নিকেশে বসতেন। যাদের কাছ থেকে ঋণ করেছেন আনুপাতিকহারে সবাইকে ভাগাভাগি করে শোধ করতেন। শুধু মাত্র হাত খরচের টাকা বাদে সব দিয়ে দিতে হয়েছে। খুব ন্যায় নীতিবান মানুষ ছিলেন। মানুষের দেওয়া ওয়াদা বরখেলাপ করাটা মোটেই পছন্দ ছিল না। কারো সাথে কখনোই মনমালিন্য ও ঝই জঞ্জালে জড়াতেন না। গ্রামের অত্যন্ত নরম সরম সাদাসিধে একজন মানুষ।
হোসাইন সেই বাবার ছোট ছেলে। হোসাইন গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পরবর্তী বাবার ইচ্ছায় মাদ্রাসায় ২য় শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ৫ম শ্রেণীতে উঠলে লেখাপড়া ও মেধাশক্তিতে ভালো থাকায় শিক্ষকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন হোসাইনকে দিয়ে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়াবেন। এজন্য হোসাইনকে প্রস্তুতি নিতে বললেন। তাই হোসাইনের লেখাপড়ায় একটু চাপ পড়ে যায়। মাদ্রাসা ছুটির পর বাড়িতে এসে পড়ায় ব্যস্ত থাকেন হোসাইন। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় হোসাইন বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সাধারণ গ্রেটে বৃত্তিও পায় হোসাইন। বৃত্তি পাওয়াতে শিক্ষক ও বাবা মায়ের আনন্দের সীমা নেই। গ্রামের মানুষের কাছেও প্রশংসিত হয়েছেন হোসাইন।
পরবর্তীতে নিজ গ্রামের মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে মাদ্রাসা পরিবর্তন করেন। ভর্তি হন ৯ম শ্রেণীতে  গ্রাম ছেড়ে দূরে অন্য একটা দাখিল মাদ্রাসায়। এখান থেকে ১৯৯৭ সালে দাখিল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে উত্তীর্ন হয়‌। পরবর্তীতে আবার গ্রামের আলিম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। সেখান থেকে আলিম পাশ করার পরে অন্য আরেকটা ফাযিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। কিন্তু সংসারে অভাব অনটনের কারণে লেখাপড়ায় আর সামনে এগুতে পারেনি এই মেধাবী। আসে সংসারে দায়ভার কাঁধে। তাই বাধ্য হয়ে হোসাইন সংসারের বোজা মাথায় নিলেন। নেমে পড়লেন অর্থ উপার্জনে। কিন্তু কি কর্ম করে সংসার চালাবেন সে চিন্তায় বিভোর হোসাইন। বড় কোন ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন তা-তো পারবেন না। তার বাবার তো তেমন অর্থ নেই। তাই অল্প কিছু টাকা ম্যানেজ করে শুরু করলেন ব্যবসা।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ

আসলে ব্যবসা করতে যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করা প্রয়োজন তা ছিল না হোসাইনের। যার ফলশ্রুতিতে তেমন একটা ব্যবসায় লাভবান নয়‌। খুব কষ্ট করেই ধারদেনা করেই শুরু তার ব্যবসা। হোসাইনের এক ভাই দেশের বাইরে থাকেন মোটামুটি ভালোই আছেন প্রবাস জীবনে। তাকে বললেন হোসাইন আমার নতুন ব্যবসায় কিছু টাকা দরকার তুমি আমাকে কিছু টাকা দিও সহযোগিতা কর আমি কিছুদিন পর ফেরত দিবো। তিনি রাজি হলেন এবং টাকা পাঠিয়ে দিলেন হোসাইনকে। এবার শুরু হলো হোসাইনের ব্যবসায়ী জীবন।
এদিকে বড় ভাই বাবার সংসার থেকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। তিনি তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মা ও ভাই বোনদের আর খরচ বহন করতে পারছে না। যা ইনকাম করেন তা নিজের সংসারে টানাটানি করে চলে। তাই পরিস্থিতির কারণে সংসারের দায়ভার হোসাইনের কাঁধের উপর। কি আর করা আল্লাহর উপর ভরসা করে হোসাইন মা বাবার দোয়া নিয়ে সংসারের ঘাঁনি টানতে থাকে। হঠাৎ হোসাইনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন বাড়িতে বসে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ এনে খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু তেমন উন্নতি হচ্ছে না, দিন দিন তার শরীর অবনতি হচ্ছে। বড় মেডিকেলে নিয়ে চিকিৎসা করাবেন সে সমর্থ্য নেই হোসাইনের। কি করবেন ? কোথায় টাকা পাবেন কার কাছে যাবেন? ভেবে দিশেহারা হোসাইন। বাবার দিকে তাকাতেই পারছেনা হোসাইন। চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। কিন্তু মনোবল ভেঙে যায়নি যে করে হোক অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসা করাতেই হবে।
তাই নিজের কাছে যে টাকা ছিল তা নিয়ে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেকক্সে ভর্তি করে বাবাকে। কিছুদিন চলতে থাকে চিকিৎসা কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এখানে ব্যয়বহুল খরচ যা হোসাইনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। হোসাইন এবার অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কি করবে কোন পথে যাবে? কোন কুল কিনারা খুজে পাচ্ছে না। হাসপাতালে বাবার চিকিৎসায় দৌড়াদৌড়ি ও টাকার চিন্তায় ক্লান্তশ্রান্ত মন নিয়ে ব্যাকুল। রাখে আল্লাহ মারে কে! মহান সৃষ্টিকর্তা সব ফায়সালার মালিক। হোসাইনের এক বোন প্রভাবশালী ও ব্যাপক টাকার মালিক। বাবার কষ্ট ও হোসাইনের দৌড়াদৌড়ি দেখে এবার বাবার চিকিৎসায় সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে বাবাকে সুস্থ করার জন্য চিকিৎসা চালাতে লাগলেন। বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে হোসাইন দোকানে ঠিক মত সময় দিতে পারছে না। দোকান একেবারেই বন্ধ রেখে নিজের দিকে না তাকিয়ে বাবাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল হোসাইনের। অনেক ধারদেনা এবং নিজের কাছে যা পুঁজি ছিল সব শেষ করলেন বাবাকে বাঁচাতে। কিন্তু শেষমেশ আর পারলেন না। মহান বিধাতার অমোঘ নিয়মে চিকিৎসারত অবস্থায় চলে গেলেন বাবা না ফেরার দেশে। হোসাইনের আত্মচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার জীবনের আলোটা নিবে যাচ্ছে। বাবা নামক বটো বৃক্ষ বিহীন কিভাবে কাটবে হোসাইনের জীবন। হোসাইন বাবার মৃত্যুর শোক বুকে নিয়ে চলতে থাকে জীবন তরী। বৃদ্ধ মায়ের সান্তনা, আদর স্নেহ ভালোবাসায় নিয়েই নতুন করে বাঁচতে শুরু করে। হোসাইন বাবা মায়ের তথা পরিবারের সকলের দায়িত্ব তার ওপর। এমনকি
 সেবা যত্ন করতে হয় হোসাইনের। এজন্য হোসাইনকে সবাই ভালোবাসে ও ভালো জানেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ
হোসাইনের বাবার মৃত্যুর পরে হোসাইন পুনরায় ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মন বসে না। সারাদিন বাবার স্মৃতি ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বাবার চলে যাওয়ার শেষ মূহুর্তটা বার বার মনে পড়ে। যেদিন তার বাবা মারা যায় সেসময়ে হোসাইন তার বাবার পাশে ছিলেন। একটা সন্তানের জন্য নিজের বাবার মৃত্যু দেখা যে কতো কষ্টকর একমাত্র সেই বুঝে যে বাবা হারায়।
হোসাইন বাবাকে হারিয়ে হাহাকার ও ব্যথিত মন সবসময় নিরব থাকে। তাছাড়া নানান সমস্যায় জর্জরিত। অর্থনৈতিক ভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার ফলে ব্যবসায় তেমন ভালো করতে পারছে না।
হোসাইন একটা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। বাজারে ব্যবসায়ীকদের মধ্যে ছিল ভীষণ প্রতিযোগিতা। একজন সু-ব্যবসায়ী হিসেবে হোসাইনের বেশ সুনাম ছিল। কিন্তু অর্থের কারণে বাজারে অন্য ব্যবসায়ীদের সাথে পেরে উঠতো না। এর ভিতরে সংসারে মা বৃদ্ধ এবং ভাইয আবার অসুস্থ। সংসারে তার স্ত্রী এবং একটা মেয়ে আছে। অর্থ সংকটে সংসার ভালো ভাবে চলেনা। তারপরেও সংসার থেকে মা এবং আত্মীয় স্বজনদের থেকে চাপ আসতে শুরু করে হোসাইনের বিয়ের। কারণ হোসাইনের বয়স হয়েছে তাই সবাই তাকে বিয়ে করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এক পর্যায়ে মেয়ে দেখাশুনা শুরু করে এবং একপর্যায়ে মেয়েও পছন্দ হয়। মেয়ের বাবা খুব বড়লোক অনেক সম্পত্তির মালিক। হোসাইনের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার কিন্তু ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ের সাথে বিয়ে তাদের সাথে এটা কিভাবে সামাজিক ভাবে সামলাবে তা ভেবে দিশেহারা হোসাইন। বাড়িতে সবার সাথে পরামর্শ করলেন কিভাবে কি করবেন। হোসাইনের এক ভাই প্রবাসী তিনি কিছু সহযোগিতা করলেন এবং আরেক ভাই বাড়িতে থাকেন তিনিও এগিয়ে আসলেন। হোসাইন তাদের সহায়তা পেয়ে ঠিক করলেন বিয়ের দিনক্ষন। বিয়েও সম্পন্ন হয় জাঁকজমকভাবে। বিয়েতে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সবাই উপস্থিত ছিলেন। বিয়েতে খরচাপাতি অনেক হলো কারণ বড়লোকের মেয়ে বিয়ে একটু তো খরচ হবেই। যাইহোক বিয়ে সম্পন্ন হলো সুন্দরভাবে।
এরপর শুরু হলো সংসার জীবন যদিও খুব কষ্টের টানাটানিতে যাচ্ছে। সংসারে আছে বৃদ্ধ মা, ভাই, ভাবি এবং একটা ভাইজি। মায়ের শরীর বেশি ভলো যায় না রোগে শোকে একেবারে নুয়ে পড়েছেন তিনি। মায়ের ওষুধে অনেক টাকা খরচ হয়। এদিকে ব্যবসার যে নগদ ক্যাশ ছিল তা বিয়েতে খরচ করে ফেলেছে। যার কারণে নতুন করে মালামাল তুলতে পারছে না।
পরবর্তীতে মহাজনের কাছে ধর্ণা দিয়ে কিছু পুঁজি বাড়িয়ে নেয় হোসাইন। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য সেই আমলে ব্যবসায় ছিল বাকির প্রতিযোগিতা আর এই প্রতিযোগিতায় হোসাইন অনেক টাকা মার্কেটে বাকি দিয়ে ফেলে। বাকি নিয়ে কাস্টমারেরা আর দোকানে আসেনা কারণ কেক যেমন মধু না থাকলে মৌমাছি ভেড়েনা তেমনি দোকানে মালের ভৈল না থাকলে কাস্টমার আস্তে আস্তে দূরে সরে যায়। এভাবে হোসাইনের ব্যবসা ধীরে ধীরে অতল সাগরে ডুবে যেতে শুরু করে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদঃ
হোসাইনের ব্যাবসা ডুবে যেতে শুরু করলেও হোসাইন হাল ছেড়ে দেয়নি। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তার আছে। এবার মহাজনের কাছ থেকে মাল বাকি নিয়ে এসে দোকান ভর্তি করে। টুকিটাকি মাল বিক্রি করে আর মার্কেটে পূর্বের বাকি দেওয়া মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে আনার চেষ্টা করতে থাকে। হোসাইনের শ্বশুর ধনাঢ্য ব্যক্তি। এলাকায় ব্যাপক সুনাম রয়েছে। একদিন হোসাইন মনে মনে ভাবে শ্বশুরের তো অনেক টাকা পয়সা, যদি তার কাছ থেকে একটু হেল্প নেই তাহলে ব্যবসাটা আরো জাঁকজমকভাবে করা যায়। কিন্তু শ্বশুর কি টাকা দিবেন.? না, চেয়ে আবার লজ্জা পেতে হয় এই চিন্তায় কিছুটা সংকোচ বোধ করছেন। তারপরেও নিরুপায় হয়ে লজ্জা-শরম ফেলে শ্বশুরকে বললেন তার ব্যবসার অবনতির কথা। চাইলেন অর্থ সহায়তা। শ্বশুর চিন্তা করলেন জামাই খুব ভদ্র ও আন্তরিক আমার ছেলেদের মতোই। যদি ব্যবসায় লাভবান হতে পারে তাহলে আমার মেয়ে সুখী হবে। ওদের সংসারের উন্নতি হবে। তিনি নির্দ্বিধায় রাজি হলেন সহায়তা করতে। তাই এককালীন কিছু টাকা দিলেন। এরই মধ্যে হোসাইন একটি এনজিও থেকেও কিছু ঋণ নিলেন।
শ্বশুরের টাকা আর এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ দিয়ে আবার ব্যবসায় নতুন করে মাল উঠালেন। দূর থেকেও দেখা যায় হোসাইনের দোকান মালে পরিপূর্ণ সাজানো। খুব সুন্দরভাবে ব্যবসা চলতে থাকে কিন্তু হোসাইনের সংসারে যে পরিমাণ খরচ তাতে ব্যবসায়ী যে আয় হয় তাতে হয় না। মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজন আসে তাদের খরচ বহন করা এবং সংসারে বড় বড় আয়োজনের খবরও এই ব্যবসার মধ্যে। তাই সংসারের ব্যয়বহুল খরচ চালাতে অনেক সময় তার ব্যবসার মূল পুঁজি থেকে খরচ করতে হয় বাধ্য হয়ে। যদিও হোসাইনের প্রবাসী ভাই কিছুটা সহযোগিতা করেন তারপরেও সবকিছু সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
ব্যবসায় যে টাকা উপার্জন হয় তার একটা অংশ এনজিও এর কিস্তি চালাতে যেয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরেও হোসাইন নিজের
মনের ভেতরে বেদনার ভার কাউকে দেননা। জীবন যুদ্ধে টাকা নিজেই জ্বলছে। কাউকে বুঝতে দেয়না। কারণ হোসাইন সমাজে একটি অবস্থান তৈরি করছে। সবাই তাকে চেনে জানে। তার বাবার মতই নিজেকে আদর্শবান মানুষ হিসেবে পড়তে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এদিকে হোসাইনের স্ত্রীর এবার গর্ভে আসে একটা সন্তান। আর সন্তান পেটে যাওয়ার পর থেকে নতুন করে ভাবনায় ফেলে। তিনি চিন্তা করেন সংসারে ব্যয়বহুল খরচ মানুষের টাকা দিয়ে ব্যবসা করে তা সামাল দেওয়া বড়ই দুষ্কর। তাই নবাগত সন্তানের জন্য কিছুটা হলো সঞ্চয় করা দরকার। তাই প্রতিদিন হোসাইন সামান্য পরিমান টাকা হোসাইন স্ত্রীর কাছে সঞ্চয় করে। যাতে আর কিছু না হলেও ডেলিভারির সময় হল কিছুটা হলেও কষ্টের লাগব হবে।
এদিকে সংসারে মা বৃদ্ধ এবং তিনি অসুস্থ। তার পিছেনে প্রতি মাসে একটা টাকা খরচ করতে হয়। তারপরেও সংসারে আরও খরচ এবার আসছে নতুন অতিথি।
পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ
মহান স্রষ্টার অশেষ রহমতে হোসাইনের স্ত্রীর পেটের নবজাতকের পৃথিবীতে আগমন করার দিন ধীরে ধীরে কাছে আসতে শুরু করতে লাগলো। যাতে হোসাইনের স্ত্রী নবজাতক সন্তান ভালো থাকে এজন্য স্ত্রীর বিশ্রামের জন্য পাঠালেন তার বাবার বাড়ি। হোসাইনের স্ত্রী চাচ্ছে তার সন্তানের আগমন নানার বাড়িতে হোক। হঠাৎ একদিন ভীষণ ঝড় বৃষ্টি এরই মধ্যে খবর আসে হোসাইনের কাছে তার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। হোসাইন তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বের হলেন টাকার খোঁজে। কারণ তাকে হাসপাতালে নিতে হবে সিজার করাতে অনেক টাকা প্রয়োজন। কোথায় পাবেন টাকা। কিইবা এই বিপদে এগিয়ে আসবে, কার কাছে হাত পাতবে হোসাইন.? এই ভেবে দিশেহারা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো বাড়িতে তাদের কিছু জমানো টাকা আছে মাটির ব্যাংকে। কোথায় দেরি না করেই ছুটলো হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে শেষ সম্বল মাটির ব্যাংক ভেঙে বেশ কিছু টাকা পেলো।
হোসাইন সেই টাকা হাতে নিয়ে মা এবং ভাই ভাবিদের কাজ থেকে দোয়া নিয়ে ছুটে গেলেন স্ত্রীর পাশে। শ্বশুর বাড়িতে দেরি না করে তড়িঘড়ি করে স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করালেন। ডাক্তার দেখে বললেন হোসাইনকে চিন্তার কোন কারন নেই আপনার স্ত্রীর ডেলিভারির ভালো হবে। রাতেই অপারেশন করা হবে। আপনি ব্লাড সংগ্রহ করুন, ব্লাড দিতে হতে পারে। হোসাইন বের হলেন ব্লাড সংগ্রহ করতে। আল্লাহর রহমতে ব্লাড পেয়েও গেলেন। এখন মনে মনে ভাবেন যে টাকা এনেছি এতে হবে না আরো টাকা প্রয়োজন। তাই তার যে ভাই প্রবাসে থাকেন তাকে জানালেন তিনি কিছু টাকা পাঠালেন। রাতে তার স্ত্রীকে অপারেশন থিয়েটারে নিলেন ডাক্তার। অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষায় আছেন হোসাইন। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে বললেন আপনার স্ত্রীর ছেলে হয়েছে। খবরটা শুনে হোসাইনের সারা জীবনের কষ্ট দূর হলো। মুখে হাসি ফুটল। নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সন্তান ও স্ত্রী কেমন আছেন.? নার্স হেসে বললেন আলহামদুলিল্লাহ আপনার সন্তান ও আপনার স্ত্রী সুস্থ আছেন। আপনি মিস্টি নিয়ে আসেন! হোসাইন খুশিতে আত্মহারা। কি নাম রাখবেন ভাবতেছেন। যেহেতু সময়টা ছিল প্রচুর ঝড় বর্ষা তাই ঠিক করলো ছেলের নাম ‘বর্ষা’ রাখবেন। হাসপাতালে তিন দিন থাকার পরে যখন সুস্থ হয়ে উঠল ছেলে ও স্ত্রী। তখন হাসপাতালের সমস্ত বিল পরিশোধ করে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল। শ্বশুরবাড়ি কয়েকজন থাকার পরে বাড়িতে চলে গেলেন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে। বাড়িতে নতুন অতিথি পেয়ে হোসাইন এর মা ভাবি ও মহল্লার সবাই ভীষণ খুশি। সবাই দেখতে আসে হোসাইনের ছেলেকে। হোসাইন খুশিতে সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদঃ
হোসাইন জীবনের তাগিদে স্ত্রী সন্তান পরিবারকে একটু ভালো রাখার জন্য পুনরায় ব্যবসায় মনোযোগ দিলেন। পারিবারিক ঝামেলায় বেশ কিছুদিন ব্যবসায় সময় দিতে না পারায় অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। কিছুটা অগোছালো। চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়াতে তাই ব্যবসায়িক চিন্তায় কিছুটা নতুন কৌশল অবলম্বন করে তা আবার স্বাভাবিক ভাবে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। স্ত্রীর অসুস্থতায় সন্তান ডেলিভারির সময় বেশ কিছু টাকা খরচ হয় যার ফলে ব্যবসায় কিছুটা অর্থনৈতিকভাবে সমস্যা সৃষ্টি হয়। হোসাইন খুবই কর্মঠ এবং বুদ্ধিমত্তায় সেটা আবার পুনারয় টাকা ম্যানেজ করে ব্যবসার ঘাটতি পুরন করতে সক্ষম হয়। হোসাইন যে কাজে যায় মায়ের নিকট থেকে দোয়া এবং বাবার কথা স্মরণ করে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে চলতে থাকে, যার ফলে অভাব থাকলেও মালুম হয়না। সবই মা বাবার দোয়া এবং আল্লাহর কৃপা। হোসাইনের সংসারে মা বৃদ্ধ এবং অসুস্থ, তার পিছনে অনেক খরচ হয় সাথে নতুন করে একটা অথিতি, তার পিছনেও একটা বাড়তি খরচ হয়, অবশ্যই মায়ের জন্য একটা খরচ হোসাইনের ভাই সহযোগিতা করে। এভাবে হোসাইন আত্মীয়স্বজন, মা ভাই বোন স্ত্রী সন্তান নিয়ে চলতে থাকে। এরই মধ্যে হঠাৎ সংসারে আচমকাই হাওয়ার মত ঝড় ওঠে। আমাদের সমাজের সবার সংসারে ঝামেলা টুকিটাকি থাকে। সেই হিসাবে হোসাইনের সংসারে ভাই আছে সাথে তার মেয়ে এবং স্ত্রী। হোসাইনের সেই ভাই পৃথক হওয়ার জন্য ঝামেলা সৃষ্টি করে এবং এক পর্যায়ে পৃথক হয়ে যায়। যাই হোক আল্লাহ যেটা করে ভালোর জন্য করে। হোসাইন প্রতিদিন সকালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগের মত যায়।  তবে তার মনে সব সময় কি যেন ভাবে! কি করবে আর কি হবে? এ সাগর কি করে পাড়ি দিবে? মাঠে তেমন বেশি জায়গা জমি নেই যে। যে সেখান থেকে ভালো কিছু আসবে! সবই আল্লাহর ইচ্ছা, হোসাইন মাঝেমধ্যে বাবার কবরস্থানে যায় আর মায়ের পাশে বসে সার্বিক বিষয়ে পরামর্শ নেয় কিভাবে চালাবে এ সংসার।
সপ্তম পরিচ্ছেদঃ
মহাজন অনেক টাকা পাবে হোসাইনের কাছে। আর হোসাইন ও মার্কেটে পাবে অনেক টাকা কিন্তু সে বাকি পড়া টাকা উঠাতে পারছে না। টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে হোসাইন। একেতো সংসারের পিছনে খরচ তার পরে আবার এনজিওয়ের মাসিক কিস্তি সম মিলিয়ে হোসাইন বেশি ভালো নেই। তার মাথায় চিন্তা সর্বদা ঘুরতে থাকে। শুরু হয়ে যায় বাৎসরিক হালখাতার সময়, হোসাইন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হালখাতা করবে। তার আশা এখান থেকে এককালীন মোটা অংকের টাকা পাবে। সে টাকা দিয়ে মহাজনের ঋণ শোধ করে আবার ব্যবসা ভালো করে করবে বলে মনস্থ করলো। বাৎসরিক হালখাতার জন্য প্রস্তুতি শুরু করলো হোসাইন এবং দিনক্ষণ ঠিক করলো। সবার কাছে হালখাতার দাওয়াত পত্র পৌছে দিলেন। হালখাতার দিন আসলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য হালখাতায় আশানুরূপ কালেকশন হলো না। এবার হোসাইন কি করবে সেই ভাবনায় অস্থির। হোসাইন তার স্ত্রী এবং মা, ভাইদের সাথে পরামর্শ করে, কি করবে? সবাই পরামর্শ করলেন ব্যবসা বাদ দিয়ে মহাজনের টাকা পরিশোধ করে দিতে। হোসাইন মনে মনে একাকী ভাবছে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে কি করবে। তারপরও যেহেতু বাড়ির সবাই পরামর্শ দিলেন ব্যবসা ছেড়ে দিতে তাই হোসাইন যথাযথ ভাবে সেটাই করলেন। এবং ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন।
ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লেন হোসাইন। টাকা পয়সা নাড়াচাড়া করা মানুষের হাতে টাকা না থাকলে কি হয় তিনি ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি তা অনুভব করতে পারবেন না। হোসাইনের মা অসুস্থ সাথে সংসারে স্ত্রী সন্তান ও অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কিভাবে কাটবে তার সংসার জীবন সেই ভাবনা হোসাইন একেবারেই কাবু হয়ে পড়েছেন। পরিবর্তন হয়েছে তার মানসিকতার। হোসাইনের মানসিকতার পরিবর্তন দেখে তার মা, স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পরামর্শে বসলেন কিভাবে এর থেকে উত্তরণ হওয়া যায়।
হোসাইন মা এবং স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলো যে, বাড়ির গাছ কেটে বিক্রয় করে বাড়ির পাশে একটা নতুন করে ছোট খাটো ব্যবসা দিবে। ওনারাও রাজি হলেন। তবে যে গাছ আছে বাড়িতে তা বিক্রি করে যে টাকা আসবে তাতে ব্যবসা হয়না। তাই হোসাইনের মা বললেন হোসাইনকে যে তোমার ভাইয়ের কাছে বলো বিষয়টি।
মায়ের কথা মতো ভাইকে বলাতে তিনিও কিছু সাহায্য করলো। এবার শুরু আবার নতুন ব্যবসায়ী জীবন। ব্যবসায় তাদের পরিবার মোটামোটি ভালোই চলছিলো
হঠাৎ হোসাইনের ভাই একটা ব্যবসায় হোসাইনের দুলাভাইয়ের সাথে জড়িত হয়ে হোসাইনের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে দুলাভাইয়ের ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। হোসাইন সততার সাথে হোসাইনের ভাই এবং দুলাভায়ের ব্যবসার দায়িত্ব পালন করতে লাগলো। হঠাৎ হোসাইনের ভাই দুলাভাইয়ের সাথে ব্যবসা থেকে পৃথক হয়ে গেলো। হোসাইন পড়ে গেলো মহাবিপদে কি করবে ভাবনা চিন্তা করতে থাকে যে ভাই নিয়ে আসলো এখানে আর ভাই ব্যবসা থেকে পৃথক হলো! হোসাইনের মানসিকতা চিন্তা-ভাবনার এটা দেখে দুলাভাই দিলেন তার ব্যবসার দায়িত্ব। যেহেতু হোসাইন একজন সৎকর্মশীল মানুষ। তাকে রাখলে অবশ্যই ব্যবসার উন্নতি হবে।
অষ্টম পরিচ্ছেদঃ
মহান স্রষ্টার অসীম দয়ায়, মায়ের দোয়া ও মানুষের ভালোবাসায় হোসাইন দুলাভাইয়ের ব্যবসার দায়িত্ব নিলেন। এখান থেকে যে বেতন পায় তা দিয়ে সংসার পরিচালনা করছেন। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরে হোসাইনের স্ত্রীর পেটে একটা নতুন অথিতি আসলো।   ধীরে ধীরে পেটের সন্তান বড় হতে শুরু করলো। হোসাইনের সংসারে নানান ঝামেলা, মা অসুস্থ তার পিছনে সময় দিতে হয় সাথে স্ত্রী, সন্তান আত্মীয়স্বজন! সবকিছু সামলানোর দায়িত্ব হোসাইনের। এদিকে হোসাইনের স্ত্রীর ডেলিভারির সময় আগত। হোসাইনের স্ত্রীর ডেলিভারির সময় হলো। তাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার বললেন রাতেই অপারেশন। হোসাইন অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষায়! হঠাৎ সংবাদ এলো হোসাইন কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। এই সংবাদ শুনে হোসাইন মহান স্রষ্টা দরবারে শুকরিয়া জানালেন। নার্সেরা হোসাইনের মেয়েকে এনে দিল হোসাইনের কোলে। হোসাইন মেয়েকে কোলে নিয়ে খুশি ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে মেয়ের নাম রাখলো (যার অর্থ আনন্দময়)। হোসাইন নার্সদের মিষ্টি খাওয়ার টাকাও দিলেন; টাকা পেয়ে নার্সরা ভীষণ খুশি। হোসাইন সারারাত হাসপাতালে স্ত্রী সন্তানের পাশে থেকে সকালে আবার দুলাভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ নিজ কর্মস্থলে যায়। সেখান থেকে দিনে কয়েকবার আসতে হয় হাসপাতালে তাকে। হাসপাতালে কয়েকদিন থেকেই সুস্থ হয়ে উঠে তার স্ত্রী। পরবর্তীতে হাসপাতাল থেকে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে কিছুদিন রাখার পরে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসলো স্ত্রী সন্তানকে। হোসাইনের সংসার এবার ফুলে ফুলে ভরে যেতে লাগলো। মেয়ে সন্তান একটা আল্লহর রহমত সেটা বাস্তবেও বুঝতে পারলো হোসাইন। আল্লাহর রহমতে মানুষের ভালোবাসা, আত্মীয়স্বজনের দোয়া, মা বাবার আশির্বাদ আর মেয়ে সন্তানের আবির্ভাবে হোসাইন দিন বেশ আনন্দ উল্লাসে চলতে থাকে। মেয়ে সন্তান হোসাইনের সংসারে আবির্ভাবের ফলে সংসারে আয় উন্নতি বাড়তে শুরু হলো। এসকল অবদান হলো মা-বাবার ও মানুষের ভালোবাসার ফসল। আল্লাহর রহমত তো সাথে আছে তার।
মানুষ যাকে ভালোবাসে আল্লাহর ফেরস্তারাও তাকে ভালোবাসে। আর আসমানের ফেরস্তারা যাকে ভালোবাসে স্বয়ং আল্লাহও তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। হয়ত হোসাইন সেই আল্লহর সেই মহিমা পেয়েছে যার ফলে তার সংসার ফুলে ফলে ভরে উঠতে শুরু করেছে।
নবম পরিচ্ছেদঃ
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হোসাইনের সংসার আল্লাহর রহমতে বেশ ভালোই চলছে। সৎকর্ম ও ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় এবং নিয়ত যদি সঠিক থাকে কোন কাজ থেমে থাকেনা মানুষের। সেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে হোসাইন সামনের দিকে এগুতে থাকেন। যদিও হোসাইনের শারীরিক অবস্থা বেশি একটা ভালো নয়, রোগ বাসা বেঁধেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে মহা স্রষ্টার অসীম দয়ায় দুলাভাইয়ের ব্যবসার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। দুলাভাইও তাকে একটু সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকেন যারফলে তেমন শারীরিক চাপ নিতে হয় না।
মূলত হোসাইনের শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণ হলো মা, স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সবসময় টেনশনে থাকার কারণে।
হোসাইন অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যাঙ্গনে অনেকটা সুনাম অর্জন করে ফেলেছে। বাবার স্মৃতি বুকে ধারণ করে কবিতা, গল্প, ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর কলাম লেখে এবং বিভিন্ন সাহিত্যিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। হোসাইন  লেখালেখিতে বিভিন্ন সংগঠন থেকে বেশ কিছু  সম্মাননা ক্রেস্ট, অ্যাওয়ার্ড ও সনদ অর্জন করেন। সবই আল্লাহর ইচ্ছা আর মা বাবার দোয়া আর মানুষের ভালোবাসা সাথে দুলাভাইয়ের নেক নজরের জন্য হয়ত হোসাইন এসব পেতে সক্ষম হয়েছে। আল্লাহর রহমত মানুষের ভালোবাসা, মা বাবার দোয়া আর হোসাইনের দুলাভাই যদি সুযোগ সুবিধা না দিতেন হয়ত কখনোই এসব অর্জন সম্ভব হতোনা। সেক্ষেত্রে বড় অবদান হোসাইনের দুলাভাইয়ের। হোসাইনের দুলাভাই যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সুযোগ না দিত তাহলে হয়ত হোসাইন এসব করার সুযোগ পেতোনা। যাইহোক সবই আল্লাহর ইশারায় হয়েছে সেইটা অবশ্যই মানতে হবে। হোসাইন দায়িত্ব এবং কর্তব্যে সব সময় অবিচল, কোনো সময় দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলা করেনা। কোথাও কোনো সময় দিতে চাইলে যথাসময়ে সেখানে পৌছানোর চেষ্টা করে সাথে লেনদেনেও কথা কাজ ঠিক রাখার চেষ্টা করে। এইটা হোসাইনের বাবার আদর্শ ও শিক্ষা।
দশম পরিচ্ছেদঃ
হোসাইনের মায়ের বয়স হয়েছে তিনি প্রায় সময় অসুস্থ থাকেন। হোসাইন মায়ের জন্য একজন চিকিৎসক ঠিক করে রেখেছেন। তিনি মাঝেমধ্যে মায়ের শরীর চেকআপ করে থাকেন। এদিকে বাড়ির সকলের অনুরোধে আবার হোসাইনের স্ত্রী পেটে সন্তান ধারণ করেন। এবার হোসাইনের আবার বাড়তি চাপ এসে গেলো সংসারে। মা অঁচল তারপর আবার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। সব মিলিয়ে অসুস্থ শরীরে হোসাইনের মাথার উপরে এসে গেলো বড় ধরনের চাপ।
হোসাইন দুলাভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডিউটি করে পাশাপাশি সাংবাদিকতা, নিজের লেখালেখি ও সাহিত্যাঙ্গনের সময় দিতে হয়। যেহেতু এগুলো তার নেশা। সবকিছু ঠিকঠাক রাখার শক্তি মহান স্রষ্টার দান। সাথে মায়ের অনুপ্রেরণা তাকে সাহস যোগায় সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
হোসাইনের স্ত্রীর পেটের বাচ্ছা দিন দিন বাড়তে শুরু করলো। স্ত্রীর পিছনে বাড়তি খরচ শুরু হয়ে গেলো। তা সামলাতে হচ্ছে তাকে। হঠাৎ একদিন হোসাইনের স্ত্রী বাবার বাড়ি বেড়াতে যায়। সেই রাতেই হোসাইনের মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। হোসাইন স্ত্রীকে সংবাদ দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। হোসাইন মায়ের অসুস্থতার খবর তার ভাই বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের জানান।
 মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে একে একে সবাই বাড়িতে চলে আসলো। মায়ের অবস্থা খারাপ দেখে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো দ্রুত চিকিৎসার জন্য মেডিকেলে ভর্তি করার। হাসপাতালে ডাক্তার দেখে বললেন আপনার মায়ের অপারেশন লাগবে। তাই মায়ের সুস্থতার জন্য অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিলো। অপারেশন করতে ব্যবহার করা যাবে এই টাকা সকল ভাই বোন মিলে দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলো।
হোসাইন এবার পড়ে গেলো ভীষণ চিন্তায়। কারণ মায়ের চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসকায় তাকে হাসপাতালে সময় দিতে হবে। এদিকে স্ত্রী অসুস্থ তাকে নিয়েও টেনশন তার। তাছাড়া কর্মস্থলেও সময় দিতে হবে। দুলাভাইয়ের প্রতিষ্ঠান বলে অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন; আর কত ? এবার মায়ের চিকিৎসায় যদি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকে তাহলে চাকরি থাকবে কি-না সে টেনশন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পরবর্তীতে হোসাইনের দুলাভাই সবকিছু জেনেছেন। তিনি অত্যন্ত ভালো মনের মানবিক মানুষ। তার সমাজে সুনাম রয়েছে। তাই হোসাইনের পারিবারিক সমস্যার সমাধান ও মায়ের চিকিৎসার জন্য সুযোগ দিলেন। এবার দুলাভাইয়ের আন্তরিক সহমর্মিতায় মাকে হাসপাতালে ভর্তি করালেন। শুরু হয় মায়ের চিকিৎসা। সেক্ষেত্রে তার ভাই বোনেরাও সহযোগিতা করছেন অর্থাৎ পরিবারের যৌথ প্রচেষ্টায় চলছে মায়ের চিকিৎসা। প্রথমে কিছু পরিক্ষা নিরীক্ষা করা হলো তারপর অপারেশন হলো। হোসাইন বাড়ি, হাসপাতাল ও কর্মস্থলে সমান তালে সময় দিতে দিতে নিজের শরীরের দিকে নজর দেওয়ার সময় পাচ্ছে না। মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে আসছে বড্ড ক্লান্ত হোসাইন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে থেকে নেই হোসাইন। কি আর করার মাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। ভাই বোনেরাও কমবেশি টাকা পয়সা দিয়েছেন। কিন্তু তারা মায়ের চিকিৎসায় তেমন সময় দিতে পারে না। সংসার, চাকরি মায়ের চিকিৎসা সবকিছুই হোসাইনের একার সামলাতে হচ্ছে। মায়ের সফল চিকিৎসা শেষে এবার হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে নিয়ে আসার পরেও তার মা সুস্থ না। দিনে তিনবার অপারেশনের স্থানে ডেসিং করতে ডাক্তারকে নিয়মিত বাড়িতে আনতে হয়। হোসাইন নিজের অসুস্থ ভুলে মাকে সুস্থ করতে এবং সাংসারিক সকল ঝামেলা সামলিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্যই মহান আল্লাহর রহমতে চাকুরিতে ডিউটি সমানে করতে লাগলো।
একাদশ পরিচ্ছেদঃ
এইভাবে অনেকদিন চলতে থাকে। এদিকে হঠাৎ রাতে হোসাইনের স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেলো। তাকে দ্রুত মেডিকেলে নেওয়া দরকার। কিন্তু কি করবেন হোসাইন বাড়িতে একা। এতো দিন মায়ের পাশে বড় বোন ছিলেন তিনি দুদিন আগে বাড়িতে গেছেন। তার তো সংসার আছে কতদিন আর থাকা যায়। হোসাইন অসুস্থ মাকে কার কাছে রেখে যাইবে? এই ভাবনায় দিশেহারা। এদিকে স্ত্রীরও ব্যথার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এবার হোসাইন মাথা ঠান্ডা করে রাতে শাশুড়িকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে সকালে বাড়িতে আসতে বললেন। সারারাত ঘুমহীন হোসাইন। সকালে শাশুড়ি এলেন তাকে নিয়ে স্ত্রীকে পাঠালেন হাসপাতালে। মায়ের কাছে হোসাইন রইলেন। এরিই মধ্যে হোসাইনের বড় বোন বাড়িতে চলে আসলেন। বোনকে মায়ের কাছে রেখে ছুটলেন হোসাইন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখলেন যে ডাক্তার অপারেশন করবেন তিনি এখনও আসেনি। এদিকে স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে হোসাইন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেন না। একবার নার্সদের কাছে আরেকবার ডাক্তার আসছে কিনা তা দেখাতে ছুটাছুটি করছেন। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার আসলেন। ডাক্তার দেখে বললেন হোসাইনকে রোগীর রক্তের ঘাটতি আছে দু’ব্যাগ রক্ত ম্যাসেজ করেন। অপারেশন হবে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। হোসাইন এবার রক্তের সন্ধানে বিভিন্ন যায়গায় যোগাযোগ করতে দুব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করলেন।
যথাসময়ে রক্তের ডোনার হাসপাতালে পৌঁছালো, এবার হোসাইনের স্ত্রীকে অপারেশনের জন্য অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে নিয়ে গেলো। হোসাইন রক্তের ডোনার নিয়ে এবং পরিবারের লোক নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছেন। কখন আসবে সুসংবাদ। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরে সংবাদ আসলো হোসাইন ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছেন। হোসাইন খুশীতে আত্মহারা, মহান স্রষ্টার দরবারে শুকরিয়া জানালেন। তবে খবর পেলেন স্ত্রী ও ছেলে অসুস্থ। এটা শুনে হোসাইনের বিষাদে ভরে উঠলো মন। সবাই মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া প্রার্থনা করতে লাগলেন। আল্লাহ দয়ালু দাতা মেহেরবান। কিছুক্ষণ পর হোসাইনের স্ত্রী সন্তানকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে মা ছেলেকে আলাদা আলাদা ওয়ার্ডে রাখলেন নার্সরা, চলছে তাদের চিকিৎসা। হোসাইন  একবার স্ত্রীর কাছে আর একবার সন্তানের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে ক্লান্ত। এদিকে মা অসুস্থ তার কাছেও যেতে হয়। তাই নিরুপায় হয়ে স্ত্রী সন্তানকে দেখাশোনার জন্য একজন লোক ঠিক করলেন। তাকে স্ত্রী সন্তানের পাশে রেখে রাতেই বাড়িতে ফিরলেন মায়ের কাছে। হোসাইন বাড়িতে এসেই অসুস্থ মায়ের সাথে দেখা করলেন নিলেন খোঁজ খবর। রাত গভীর হওয়ায় ঘুমাতে গেলেন। হোসাইন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে মায়ের সেবাযত্ন করে ছুটলেন কর্মস্থলে। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার ফিরলেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্ত্রী সন্তানের কাছে।
চাকরি পাশাপাশি এভাবেই চলছে হোসাইনের দিন। তার অসুস্থ শরীরে অনেক চাপ তা বয়ে বেড়াতে যদিও অনেক কষ্ট। তারপরেও কিছু করার নাই, দায়িত্ব আর কর্তব্যে হোসাইন বাঁধা। মহান আল্লাহ তাকে ধৈর্যশক্তি ও মেধা দিয়েছেন বলেই শত কষ্টের মাঝেও সবকিছু সামলাতে সক্ষম হয়েছেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদঃ
হোসাইন স্ত্রীর অপারেশনের ৩য় দিন সকালে অপারেশনের ক্ষতস্থানের সেলাই কাটার কথা। সেলাই কেটে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিবেন ডাক্তার সেই প্রত্যাশায় একদম সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে মায়ের খাবার দাবার শেষ করে ঔষধ খাওয়ালেন। পরে মায়ের সাথে কথা বলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো হোসাইন। বাড়ি থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর হোসাইনের মনের মধ্যে কেমন যেনো ধাক্কা লাগছিল মনে আচমকা কেমন জানি লাগছিলো। এর কিছুক্ষণ পরেই বাড়ি থেকে ফোন আসলো হোসাইনের কাছে যে, তোমার মা আর এ পৃথিবীতে নেই! তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নিয়েছেন। তুমি ফিরে এসো বাড়িতে। হোসাইন এ খবর পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজেকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছেন না। এই মাত্র মাকে খাবার ও ওষুধ খাইয়ে দিয়ে মা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। মোটেও বিশ্বাস করতে পারছে না হোসাইন। কি করবে, কোথায় যাবে? চিন্তায় বিভোর।
রাস্তার পাশে মোটরসাইকেল দাঁড় করে কিছু সময় মনস্থির করে দাঁড়িয়ে থাকলো। কিচ্ছুক্ষণ পরে হোসাইন ভাই-বোনদের কাছে ফোনে সংবাদ দিয়ে দিলো এবং হোসাইনের স্ত্রীর কাছে অর্থাৎ হাসপাতালে মায়ের মৃত্যুর খবর দিয়ে দিলো। হোসাইনের এবার কঠিন পরীক্ষায় কি হবে সেটা ভাবতে লাগলো।
বাস্তব ও নির্মমতার কাছে হার মানতে হবে তাকে। মাকে হারানোর বেদনা আর কষ্ট নিয়ে কর্তব্য আর দায়িত্বের কাছে হার মেনে হোসাইন শ্বশুরের নিকট ফোন দিয়ে তাকে হাসপাতালে স্ত্রী সন্তানের কাছে পাঠালো।
হোসাইন বাকরুদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির  উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সামনে পথ আগায় না তার। কি ভীষণ যন্ত্রণা; মনের মধ্যে হাউমাউ করছেন।
আল্লাহর লীলা-খেলা বোঝা বড় দায়! একদিকে মায়ের মৃত্যু অন্যদিকে হাসপাতালে শিশু সন্তান আর স্ত্র। বুকে পাথর চাপা দিয়ে বাড়ি চলে আসলো মৃত্যু মায়ের পাশে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন পাড়া মহল্লা থেকে বহু লোকের সমাগম, সবাই শোকাহত। কারণ হোসাইনের মা গ্রামের আট দশটা মায়ের চেয়ে একটু আলাদা ছিলেন। সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। কখনও কারো সঙ্গে মুখ মলিন করে কথা বলতেন না। যদিও সংসারে অভাব অনটন ছিল তারপরও হোসাইনের প্রতি তার আলাদা মমতা ছিল। হোসাইন ছুটে চলে গেলেন মায়ের কাছে। মায়ের প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে।  হোসাইন এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে হোসাইন। হোসাইনের আহাজারি দেখে সবার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। তারপরও
আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে শান্তনা তাকে দিচ্ছে। হোসাইনের মাকে গরম পানি বড়ই পাতা দিয়ে গোসল করিয়ে সাদা কাপড় পড়িয়ে বাড়ির পাশের ঈদগাহের মাঠে নিয়ে জানাযা নামাজ আদায় করে হোসাইনের পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে দাফন সম্পন্ন করা হলো।
এদিকে হোসাইন মাকে হারানো শোকে ভুলেই গেছে যে তার হাসপাতালে স্ত্রী সন্তান চিকিৎসারত। তারপরেও শোকার্ত মনকে শান্তনা দিয়ে হাসপাতালে খবর নিতে লাগলো। হোসাইনের বাড়ি থেকে মায়ের দাফন শেষে আত্মীয়স্বজন সবাই যার যার মত করে তাদের গন্তব্যে চলে গেলো। শুধু বাড়িতে থাকলো হোসাইনের তিনটি বোন, তাদের মধ্য থেকে আবার দুইজন বাড়ি গেলো। হোসাইনের কাছে থাকলো সেই বড় বোন, যে বোনটা মায়ের অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই মায়ের কাছে ছিলো।  হোসাইন সারারাত ঘুমাতে পারেনি মায়ের স্মৃতিগুলো তার সামনে ভাসে। মাকে হারিয়ে ব্যাকুল হোসাইন। এদিকে  হাসপাতালে স্ত্রী সন্তানের চিন্তায় মনের ভেতরে বেদনা জ্বলে উঠে। যাইহোক সকাল হলো হোসাইন ফজরের নামাজ পড়ে একটা গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো এবং হাসপাতালে পৌছিয়ে হাসপাতালের সকল বিল পরিশোধ করে স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। হোসাইনের মাথার উপর দিয়ে এত ঝড় ঝাপটা চলে গেলো তারপরেও আল্লহর রহমতে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনদের দোয়া ও ভালোবাসায় সকলের কাছে প্রশংসনীয় ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেলো। তারই ধারাবাহিকতায় হোসাইন এই নবজাতক পুত্র সন্তানের নাম রাখলো যার অর্থ বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাময় অর্থাৎ।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদঃ
একজন সুসন্তান যেমন বাবা-মায়ের জন্য সম্পদ, তেমনি ভালো মা-বাবাও সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ নেয়ামত।
সেক্ষেত্রে হোসাইন তার মা-বাবা জন্য শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। হোসাইন নিজের শরীরের যত্ন ও স্ত্রী সন্তানদের দিকে ঠিকঠাক সময় না দিতে পারলেও মা বাবার সেবা যত্ন নিতেন সকল ব্যস্ততা ফেলে। বাবা-মায়ের সেবা যত্ন ও তাঁদের চিকিৎসার জন্য খরচ করলে বা তাদের সন্তষ্টি অর্জন করতে পারলে আল্লাহ সর্বদা সেই সন্তানের সকল কাজে সহজ করে দেয়। এবং সমাজে মান সম্মান
বাড়িয়ে দেয়। আর কখন কোন অবস্থায় মানুষের  অর্থ-সম্পদ এবং সম্মান বাড়িয়ে দেন সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। পবিত্র কুরআন সরা আল ইমরানে উল্লেখ আছে ‘আল্লাহ যাকে মনোপুত
মনে করেন তাকেই রাজা আবার কাউকে প্রজা, কাউকে সম্মান বাড়িয়ে দেন, আবার তার মনোপুত না হলে সম্মান কেড়ে নেন’ সবই আল্লাহর খেলা। তবে বাবা মায়ের খেদমতে সন্তুষ্টি হলে আর বাবা মা যদি সন্তানের জন্য দোয়া করেন অবশ্যই আল্লাহ সেই দোয়ার বরকতে সেই সন্তানকে সর্বোচ্ছ সম্মান এবং আয় রোজগার বাড়িয়ে দেন। হোসাইন এর বাবা একজন ধার্মিক এবং লেখা লেখিতে বেশ পটু ছিলেন। অনেকগুলো বই-ও লিখেছেন কিন্তু অর্থাভাবে প্রকাশ করাতে পারেনি। হোসাইন-ও বাবার মতো লেখালেখির প্রতি ভীষণ টান; তাই লিখেন কবিতা ও গল্প। হোসাইনের কবিতা, গল্প ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখালেখি করে সাহিত্যাঙ্গনে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন হোসাইন।
হয়ত এটা হোসাইনের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনদের ভালোবাসা এবং দোয়ার বরকতে মহান সৃষ্টিকর্তা সহায়ক হয়েছেন। হোসাইনের বাবা ছিলেন খুব আল্লাহ ভীরু তাই হোসাইনকে ছোট বেলা থেকেই দীনের (ইসলামী জীবন বিধান) শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
যাতে তারা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে। আসলে এটা ঠিক আমাদের বাবা-মা দীনের পথে চলে তাহলে তাদের দেখে ছেলে মেয়েরা সঠিক শিক্ষা পায়। এটা একটা সমন্বিত ব্যবস্থা। যে যার মত চললে হবে না। দীনদার সন্তানই বাবা মায়ের জন্য সম্পদ। যা হোসাইনের সুখ দুঃখের  জীবনের গল্পগাথায় প্রকাশ পেয়েছে।
বলা বাহুল্য , দীনদার বাবা মাও সন্তানদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।
   (সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *