এইভাবে অনেকদিন চলতে থাকে। এদিকে হঠাৎ রাতে হোসাইনের স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেলো। তাকে দ্রুত মেডিকেলে নেওয়া দরকার। কিন্তু কি করবেন হোসাইন বাড়িতে একা। এতো দিন মায়ের পাশে বড় বোন ছিলেন তিনি দুদিন আগে বাড়িতে গেছেন। তার তো সংসার আছে কতদিন আর থাকা যায়। হোসাইন অসুস্থ মাকে কার কাছে রেখে যাইবে? এই ভাবনায় দিশেহারা। এদিকে স্ত্রীরও ব্যথার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এবার হোসাইন মাথা ঠান্ডা করে রাতে শাশুড়িকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে সকালে বাড়িতে আসতে বললেন। সারারাত ঘুমহীন হোসাইন। সকালে শাশুড়ি এলেন তাকে নিয়ে স্ত্রীকে পাঠালেন হাসপাতালে। মায়ের কাছে হোসাইন রইলেন। এরিই মধ্যে হোসাইনের বড় বোন বাড়িতে চলে আসলেন। বোনকে মায়ের কাছে রেখে ছুটলেন হোসাইন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখলেন যে ডাক্তার অপারেশন করবেন তিনি এখনও আসেনি। এদিকে স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে হোসাইন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেন না। একবার নার্সদের কাছে আরেকবার ডাক্তার আসছে কিনা তা দেখাতে ছুটাছুটি করছেন। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার আসলেন। ডাক্তার দেখে বললেন হোসাইনকে রোগীর রক্তের ঘাটতি আছে দু’ব্যাগ রক্ত ম্যাসেজ করেন। অপারেশন হবে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। হোসাইন এবার রক্তের সন্ধানে বিভিন্ন যায়গায় যোগাযোগ করতে দুব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করলেন।
যথাসময়ে রক্তের ডোনার হাসপাতালে পৌঁছালো, এবার হোসাইনের স্ত্রীকে অপারেশনের জন্য অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে নিয়ে গেলো। হোসাইন রক্তের ডোনার নিয়ে এবং পরিবারের লোক নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছেন। কখন আসবে সুসংবাদ। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরে সংবাদ আসলো হোসাইন ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছেন। হোসাইন খুশীতে আত্মহারা, মহান স্রষ্টার দরবারে শুকরিয়া জানালেন। তবে খবর পেলেন স্ত্রী ও ছেলে অসুস্থ। এটা শুনে হোসাইনের বিষাদে ভরে উঠলো মন। সবাই মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া প্রার্থনা করতে লাগলেন। আল্লাহ দয়ালু দাতা মেহেরবান। কিছুক্ষণ পর হোসাইনের স্ত্রী সন্তানকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে মা ছেলেকে আলাদা আলাদা ওয়ার্ডে রাখলেন নার্সরা, চলছে তাদের চিকিৎসা। হোসাইন একবার স্ত্রীর কাছে আর একবার সন্তানের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে ক্লান্ত। এদিকে মা অসুস্থ তার কাছেও যেতে হয়। তাই নিরুপায় হয়ে স্ত্রী সন্তানকে দেখাশোনার জন্য একজন লোক ঠিক করলেন। তাকে স্ত্রী সন্তানের পাশে রেখে রাতেই বাড়িতে ফিরলেন মায়ের কাছে। হোসাইন বাড়িতে এসেই অসুস্থ মায়ের সাথে দেখা করলেন নিলেন খোঁজ খবর। রাত গভীর হওয়ায় ঘুমাতে গেলেন। হোসাইন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে মায়ের সেবাযত্ন করে ছুটলেন কর্মস্থলে। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার ফিরলেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্ত্রী সন্তানের কাছে।
চাকরি পাশাপাশি এভাবেই চলছে হোসাইনের দিন। তার অসুস্থ শরীরে অনেক চাপ তা বয়ে বেড়াতে যদিও অনেক কষ্ট। তারপরেও কিছু করার নাই, দায়িত্ব আর কর্তব্যে হোসাইন বাঁধা। মহান আল্লাহ তাকে ধৈর্যশক্তি ও মেধা দিয়েছেন বলেই শত কষ্টের মাঝেও সবকিছু সামলাতে সক্ষম হয়েছেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদঃ
হোসাইন স্ত্রীর অপারেশনের ৩য় দিন সকালে অপারেশনের ক্ষতস্থানের সেলাই কাটার কথা। সেলাই কেটে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিবেন ডাক্তার সেই প্রত্যাশায় একদম সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে মায়ের খাবার দাবার শেষ করে ঔষধ খাওয়ালেন। পরে মায়ের সাথে কথা বলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো হোসাইন। বাড়ি থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর হোসাইনের মনের মধ্যে কেমন যেনো ধাক্কা লাগছিল মনে আচমকা কেমন জানি লাগছিলো। এর কিছুক্ষণ পরেই বাড়ি থেকে ফোন আসলো হোসাইনের কাছে যে, তোমার মা আর এ পৃথিবীতে নেই! তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নিয়েছেন। তুমি ফিরে এসো বাড়িতে। হোসাইন এ খবর পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজেকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছেন না। এই মাত্র মাকে খাবার ও ওষুধ খাইয়ে দিয়ে মা'র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। মোটেও বিশ্বাস করতে পারছে না হোসাইন। কি করবে, কোথায় যাবে? চিন্তায় বিভোর।
রাস্তার পাশে মোটরসাইকেল দাঁড় করে কিছু সময় মনস্থির করে দাঁড়িয়ে থাকলো। কিচ্ছুক্ষণ পরে হোসাইন ভাই-বোনদের কাছে ফোনে সংবাদ দিয়ে দিলো এবং হোসাইনের স্ত্রীর কাছে অর্থাৎ হাসপাতালে মায়ের মৃত্যুর খবর দিয়ে দিলো। হোসাইনের এবার কঠিন পরীক্ষায় কি হবে সেটা ভাবতে লাগলো।
বাস্তব ও নির্মমতার কাছে হার মানতে হবে তাকে। মাকে হারানোর বেদনা আর কষ্ট নিয়ে কর্তব্য আর দায়িত্বের কাছে হার মেনে হোসাইন শ্বশুরের নিকট ফোন দিয়ে তাকে হাসপাতালে স্ত্রী সন্তানের কাছে পাঠালো।
হোসাইন বাকরুদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সামনে পথ আগায় না তার। কি ভীষণ যন্ত্রণা; মনের মধ্যে হাউমাউ করছেন।
আল্লাহর লীলা-খেলা বোঝা বড় দায়! একদিকে মায়ের মৃত্যু অন্যদিকে হাসপাতালে শিশু সন্তান আর স্ত্র। বুকে পাথর চাপা দিয়ে বাড়ি চলে আসলো মৃত্যু মায়ের পাশে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন পাড়া মহল্লা থেকে বহু লোকের সমাগম, সবাই শোকাহত। কারণ হোসাইনের মা গ্রামের আট দশটা মায়ের চেয়ে একটু আলাদা ছিলেন। সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। কখনও কারো সঙ্গে মুখ মলিন করে কথা বলতেন না। যদিও সংসারে অভাব অনটন ছিল তারপরও হোসাইনের প্রতি তার আলাদা মমতা ছিল। হোসাইন ছুটে চলে গেলেন মায়ের কাছে। মায়ের প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। হোসাইন এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে হোসাইন। হোসাইনের আহাজারি দেখে সবার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। তারপরও
আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে শান্তনা তাকে দিচ্ছে। হোসাইনের মাকে গরম পানি বড়ই পাতা দিয়ে গোসল করিয়ে সাদা কাপড় পড়িয়ে বাড়ির পাশের ঈদগাহের মাঠে নিয়ে জানাযা নামাজ আদায় করে হোসাইনের পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে দাফন সম্পন্ন করা হলো।
এদিকে হোসাইন মাকে হারানো শোকে ভুলেই গেছে যে তার হাসপাতালে স্ত্রী সন্তান চিকিৎসারত। তারপরেও শোকার্ত মনকে শান্তনা দিয়ে হাসপাতালে খবর নিতে লাগলো। হোসাইনের বাড়ি থেকে মায়ের দাফন শেষে আত্মীয়স্বজন সবাই যার যার মত করে তাদের গন্তব্যে চলে গেলো। শুধু বাড়িতে থাকলো হোসাইনের তিনটি বোন, তাদের মধ্য থেকে আবার দুইজন বাড়ি গেলো। হোসাইনের কাছে থাকলো সেই বড় বোন, যে বোনটা মায়ের অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই মায়ের কাছে ছিলো। হোসাইন সারারাত ঘুমাতে পারেনি মায়ের স্মৃতিগুলো তার সামনে ভাসে। মাকে হারিয়ে ব্যাকুল হোসাইন। এদিকে হাসপাতালে স্ত্রী সন্তানের চিন্তায় মনের ভেতরে বেদনা জ্বলে উঠে। যাইহোক সকাল হলো হোসাইন ফজরের নামাজ পড়ে একটা গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো এবং হাসপাতালে পৌছিয়ে হাসপাতালের সকল বিল পরিশোধ করে স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। হোসাইনের মাথার উপর দিয়ে এত ঝড় ঝাপটা চলে গেলো তারপরেও আল্লহর রহমতে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনদের দোয়া ও ভালোবাসায় সকলের কাছে প্রশংসনীয় ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেলো। তারই ধারাবাহিকতায় হোসাইন এই নবজাতক পুত্র সন্তানের নাম রাখলো যার অর্থ বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাময় অর্থাৎ।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদঃ
একজন সুসন্তান যেমন বাবা-মায়ের জন্য সম্পদ, তেমনি ভালো মা-বাবাও সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ নেয়ামত।
সেক্ষেত্রে হোসাইন তার মা-বাবা জন্য শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। হোসাইন নিজের শরীরের যত্ন ও স্ত্রী সন্তানদের দিকে ঠিকঠাক সময় না দিতে পারলেও মা বাবার সেবা যত্ন নিতেন সকল ব্যস্ততা ফেলে। বাবা-মায়ের সেবা যত্ন ও তাঁদের চিকিৎসার জন্য খরচ করলে বা তাদের সন্তষ্টি অর্জন করতে পারলে আল্লাহ সর্বদা সেই সন্তানের সকল কাজে সহজ করে দেয়। এবং সমাজে মান সম্মান
বাড়িয়ে দেয়। আর কখন কোন অবস্থায় মানুষের অর্থ-সম্পদ এবং সম্মান বাড়িয়ে দেন সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। পবিত্র কুরআন সরা আল ইমরানে উল্লেখ আছে ‘আল্লাহ যাকে মনোপুত
মনে করেন তাকেই রাজা আবার কাউকে প্রজা, কাউকে সম্মান বাড়িয়ে দেন, আবার তার মনোপুত না হলে সম্মান কেড়ে নেন’ সবই আল্লাহর খেলা। তবে বাবা মায়ের খেদমতে সন্তুষ্টি হলে আর বাবা মা যদি সন্তানের জন্য দোয়া করেন অবশ্যই আল্লাহ সেই দোয়ার বরকতে সেই সন্তানকে সর্বোচ্ছ সম্মান এবং আয় রোজগার বাড়িয়ে দেন। হোসাইন এর বাবা একজন ধার্মিক এবং লেখা লেখিতে বেশ পটু ছিলেন। অনেকগুলো বই-ও লিখেছেন কিন্তু অর্থাভাবে প্রকাশ করাতে পারেনি। হোসাইন-ও বাবার মতো লেখালেখির প্রতি ভীষণ টান; তাই লিখেন কবিতা ও গল্প। হোসাইনের কবিতা, গল্প ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখালেখি করে সাহিত্যাঙ্গনে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন হোসাইন।
হয়ত এটা হোসাইনের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনদের ভালোবাসা এবং দোয়ার বরকতে মহান সৃষ্টিকর্তা সহায়ক হয়েছেন। হোসাইনের বাবা ছিলেন খুব আল্লাহ ভীরু তাই হোসাইনকে ছোট বেলা থেকেই দীনের (ইসলামী জীবন বিধান) শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
যাতে তারা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে। আসলে এটা ঠিক আমাদের বাবা-মা দীনের পথে চলে তাহলে তাদের দেখে ছেলে মেয়েরা সঠিক শিক্ষা পায়। এটা একটা সমন্বিত ব্যবস্থা। যে যার মত চললে হবে না। দীনদার সন্তানই বাবা মায়ের জন্য সম্পদ। যা হোসাইনের সুখ দুঃখের জীবনের গল্পগাথায় প্রকাশ পেয়েছে।
বলা বাহুল্য , দীনদার বাবা মাও সন্তানদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।
(সমাপ্ত)