ইতিহাসের পাতায় যশোর জেলা

May 10, 2023

মুহাঃ মোশাররফ হোসেন

লেখক পরিচিতিঃ
মুহাঃ মোশাররফ হোসেন ১৯৮২ খৃষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর, বাংলা ১৩৮৯ সালের ১৫ই অগ্রহায়ন রোজ বুধবার যশোর জেলার মনিরামপুর থানার অন্তর্গত ঝাঁপা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।
তাহার পিতা মওলানা আজহারুল ইসলাম। তিনি একই গ্রামে ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসার মৌলভী শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একাধিক বই রচনা করেন। মাতা মোছাঃ গফুরুননেছা। তিনি পেশায় গৃহিনী ছিলেন। ৩ বোন এবং ৪ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ট। ভাইদের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট।
ঝাঁপা পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করলেও পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী পিতার কর্মস্থল ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শেণিতে ভর্তি হয়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পরবর্তীতে কাশিপুর পীরবাড়ি দিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসায় নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয় এবং ১৯৯৭ খৃষ্ঠাব্দে দাখিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগে পাশ করেন।
পরবর্তীতে মনিরামপুর ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হলেও পিতার নির্দেশে পুনরায় ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসায় আলিমে ভর্তি হয়ে ১৯৯৯ খৃষ্ঠাব্দে আলিম পাশ করার পর খেদাপাড়া ফাযিল মাদ্রাসায় ফাযিলে ভর্তি হলেও সংসারের দ্বায়িত্ব কাধে আসায় পড়ালেখা চলমান রাখতে পারে নাই।
কর্মজীবনে পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে লেখালেখি শুরু করেন। বর্তমানে তিনি নিউজবিডিজার্নালিস্ট২৪ (অনলাইন পত্রিকা) এ নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন।

লেখকের বাণীঃ
এ বইটিতে যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকার জনপদ ও সাড়া জাগানো বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ ভাসমান সেতুর বাস্তব কিছু ইতিহাস লেখনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আশা করি এই ছোট্ট বইটি পড়লে আপনারা যশোর জেলার ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক, বানিজ্যিক, দর্শনীয় স্থান, বিনোদন পার্ক, নদ—নদী, বাওড়—বিল, স্থাপত্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, বিখ্যাত ব্যক্তিসহ অনেক তথ্য জানতে পারবেন যেটা আপনার অজানা ছিল। এ বইটি পড়ে যদি আপনার জ্ঞানের পারিধি সামান্য হলেও বৃদ্ধি পায় তবেই আমার এ ক্ষুদ্র চেষ্টা স্বার্থক হবে।

উৎসাহঃ

আমি সর্ব প্রথম স্বরণ করি পরম করুনাময় আল্লাহু তা-আলার, এর পরে স্বরণ করি আমার শ্রদ্ধীয় মরহুম পিতা আজহারুল ইসলাম। যার লেখা বই পড়ে লেখার জগতে প্রবেশের অনুপ্রেরনা পাই। এর পরে স্মরণ করি আমার শরদ্ধীয় বোন হাসিনা পারভীন এবং বোনায় মোঃ হাফিজুর রহমান, পিতা মাতার পরে স্মরণ করতে গেলে এদের দুই জনের নাম আগে আসে, যাদের অনুপ্রেরনায় আজ এ পর্যন্ত আমি এসেছি। পরবর্তীতে অনুপ্রেরণা যোগায় আমার এক দূর সম্পর্কের ভাতিজা এবং নিউজবিডিজার্নালিস্ট২৪ এর সম্পাদক ও প্রকাশক ডাঃ মোঃ রাকিব হোসেন,  এবং নিউজবিডিজার্নালিস্ট২৪ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও এডিটর ভাতিজা মোঃ আল ইমরান। বিশেষ করে এদের দুইজনের অবদান সবচেয়ে বেশি। সময় কম থাকলেও এদের উৎসাহ উদ্দিপনায় এত দূর এগিয়েছি। পাশাপাশি আমার ভাতিজা আনোয়ার হোসেন, যার সার্ভিক সহযোগিতায় বইটি প্রকাশ করেছি।

উৎসর্গঃ

বইটি আমার মরহুম পিতাঃ আজহারুল ইদলাম, মাতাঃ মোছাঃ গফুরুননেছা, সহধর্মিণী মোছাঃ তৃপ্তি খাতুন, কন্যা মোছাঃ তিশা খাতুন এবং পুত্র মোঃ ফয়সাল কবির (শাওন) এর নামে উৎসর্গ করলাম।

একনজরে যশোর জেলার দর্শণীয় এলাকার ভিডিও লিংক দিলাম দয়া করে লিংকটি ওপেন করে দেখে নিবেন সবাই https://www.facebook.com/100088703418908/posts/pfbid0gkkGKSiVc4m2CiUto4FvD4qs9c6zLKq7vHCD6PEg1reqx441RuXRAcogGAX9HCX4l/?app=fbl

যশোর জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের প্রথম স্বাধীন জেলা যশোর। বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোর।
নানা রঙের ফুল এবং খেজুর গুড় খ্যাত এই জেলাটি। বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর অপর একটি প্রচলিত নাম যশোর। ব্রিটিশ আমলে খুলনা ছিল যশোর জেলার অধিভুক্ত একটি মহুকুমা।

যশোর জেলার নামকরণের ইতিহাসঃ
যশোর নামের উতপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত মেলে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই জেলার নামকরণ সম্পর্কে মতবিরোধ দেখা যায়। আরবি”জসর”থেকে যশোর শব্দের উতপত্তি বলে মনে করেন আনেকে।
এর অর্থ সাঁকো। এককালে যশোরের সরবত্র নদীনালায় পরিপূর্ণ ছিল। নদী বা খালের উপর সাঁকো বানানো হতো। পীর খান জাহান আলী বাঁশের সাকো নির্মান করে ভৈরব নদী পেরিয়ে মুড়লীতে আসেন বলে জানা যায়। এই আরবি শব্দ “জসর” (বাংলায় যার অর্থ বাঁশের সাকো) থেকে যশোর নামের উতপত্তি। অনুমান করা হয় কসবা নামটি পীর খান জাহান আলীর দেওয়া (১৩৯৮খৃঃ)। তবে অনেকের অভিমত, খানজাহান আলী আসার আগে থেকেই যশোর নামটি ছিল। আবার অন্য একটি সুত্র হতে জানা যায় যে রাজা প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য ও তার এক সহযোগি বসন্ত রায় গৌড়ের এক চরম অরাজকতার সময় সুলতানের অপরিমিত ধনরত্ন নৌকআ বুঝায় করে গোপনে এই এলাকায় প্রেরণ করে।

যশোর জেলার পরিচিতিঃ
যশোর জেলা বাংলাদেশের দক্ষিন—পশ্চিমাঞ্চলের খুলনাবিভাগের একটি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন অঞ্চল। এর অন্য একটি প্রচলিত বানান যশোহর। ব্রিটিশ আমলে খুলনা ছিল যশোর জেলার অধিভুক্ত একটি মহুমা। এ কারনেই যশোর নামে পরিচিত।

ভৌগোলিক সীমানাঃ
উত্তরে ঝিনাইদহ জেলা ও মাগুরা জেলা, দক্ষিন পূর্বে সাতক্ষীরা জেলা, দক্ষিনে খুলনা জেলা, পশ্চিমে ভারত। পূর্বে নড়াইল জেলা।

প্রশাসনিক এলাকাঃ
এই জেলায় ৮টি উপজেলা রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে পুলিশ থানা রয়েছে। নিম্নে থানা গুলোর নামঃ
১. যশোর সদর মডেল থানা।


২. মনিরামপুর থানা।


৩. অভয়নগর থানা।


৪. কেশবপুর থানা।


৫. চৌগাছা থানা।
৬. ঝিকরগাছা থানা।
৭. বাঘারপাড় থানা।
৮. শার্শা থানা।

৯. সহকারি পুলিশ অফিসারের কার্য্যলয়।

প্রত্যেকটা থানা এখন উপজেলা হয়েছে।

ইতিহাসঃ
যশোর একটি অতি প্রাচীন জনপদ। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূরবে মিশরীয়রা ভৈরব তীরে এক সমৃদ্ধ বানিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলে। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পীর খান জাহান আলী সহ বারজন আউলিয়া যশোরের মুড়লীতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন। ক্রমে এ স্থানে মুড়লী কসবা নামে একটি নতুন শহর গড়ে ওঠে।
১৫৫৫ খ্রীষ্টাব্দের দিকে যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যশোর—খুলনা—বনগাঁ এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের অংশ বিশেষ যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৭৪৭ খ্রীষ্ঠাব্দের দিকে যশোর নাটোরের রাণী ভবানীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে যশোর একটি পৃথক জেলা হিসাবে আত্বপ্রকাশ করে এবং এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জেলা। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে ঘোষিত হয় যশোর পৌর সভা। ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে যশোর জেলা স্কুল, ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে যশোর পাবলিক লাইব্রেরী, বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে যশোর বিমান বন্দর এবং উনবিংশ শতাব্দীর হোড়ার দিকে কলকাতার সাথে যশোরের রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্বাধীন হওয়া জেলাটি যশোর।

অর্থনীতিঃ—
বেনাপোল স্থল বন্দরঃ

যশোরের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেনাপোল স্থল বন্দর যা শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বেনাপোলে অবস্থিত। ওপারে আছে পেট্রোপোল। সরকারি আমদানী শুল্ক শ্মরণে বেনাপোল স্থল বন্দরটির ভুমিকা তাতপর্যপূর্ণ। এখানকার মানূষের জীবিকার অন্যতম সুত্র বেনাপোল স্থল বন্দরের কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্টের কাজ।

নওয়াপাড়াঃ
যশোরের ব্যাবসা বানিজ্যের অন্যতম বলা হয় নওয়াপাড়াকে। এখানকার এবং আসেপাসের উদ্যাক্তাদের কারনে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা। এছাড়া ও নৌ পথে আমদানী রপ্তানী হয়ে থাকে। যা দেশের আর্থসামজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভুমিকা রাখে।

ঐতিহাসিক স্থানসমুহঃ

১. ফুলেরহাট গদখালী (ঝিকরগাছা)

২. সাগরদাড়ী, বাংলার পদ্যের জনক মাইকেল মধুসুধন দত্তের বাড়ী (কেশবপুর)


৩. তাপসকুঠির (কাষ্টম অফিস, যশোর সদর)।

৪. বেনাপোল স্থলবন্দর।

৫. যশোর বিমান বন্দর ও যশোর সেনা নিবাস।
৬. গাজির দরগাহ, ঝিকরগাছা।
৭. গদখালী কালিবাড়ি ঝিকরগাছা ।

৮. কেশবপুর ভরতের দেউল।
৮. অভয় নগরে খান জাহান আলী মসজিদ বর্তমান নওয়াপাড়া নামে পরিচিত।

৯. শ্রীধরপুর জমিদার বাড়ি, অভয়নগর।

১০. বীর শ্রেষ্ঠ লেন্স নায়েক নূর মুহাম্মদ শেখের সমাধি, শার্শা।
১১. জগদিসপুর তুলা উন্নয়ন ও বীজ বর্ধন খামার, জগদিসপুর, চৌগাছা।

বিনোদন ও প্রাকৃতিক স্থানঃ

১. বাংলাদেশের বৃহত্তম ড্রামের ভাসমান সেতু মনিরামপুরের ঝাঁপা বাওড়ের উপর।


২. মনিরামপুরে রাজগঞ্জের ঝাঁপা গ্রামের নতুন পিকনিক স্পট।

৩. মনিহার সিনেমা হল, পুরাতন খুলনা বাসস্টান, যশোর।

৪. কালেক্টরেট পার্ক, সদর, যশোর।
৫. পৌর পার্ক, সদর, যশোর ।
৬. লাল দিঘির পাড়, এম কে রোড, মাইকপট্টি।

৭. বিনোদিয়া পার্ক, সেনানিবাস, শানতলা, যশোর।

৮. যশোর বোর্ট ক্লাব, সদর, যশোর।

৯. জেস গার্ডেন পার্ক, বাহাদুরপুর, যশোর।

নদ—নদী—বাওড় ও বীলঃ

১. ভৈরব নদ।

২. কপোতাক্ষ নদ।

৩. চিত্রা নদী।

৪. মনিরামপুর—রাজগঞ্জের—ঝাঁপা বাওড়।

৫. ভবদাহ বিল, মনিরামপুর।
৬. শার্শা কন্যাদহের আশ্চার্য বাওড়।

সৃতিসৌধ ও মুরালঃ
১. বঙ্গবন্ধু মুরাল, রাজগঞ্জ বাজার, মনিরামপুর।
২. কেদ্রীয় শহীদ মিনার (এম,এম,কলেজ)।
৩. চেতনায় চিরঞ্জীব (এম,এম,কলেজ)।
৪. অদম্য’ ৭১ জবিপ্রবি।


৫. স্বদেশ চত্তর (যশোর পলিটিকনিক ইনস্টিউট)।

আধুনিক স্থাপত্যঃ

১. হাইটেক পার্ক অথবা আইটি পার্ক (শেখ হাসিনা সফটওয়ার), নাজির শঙ্কর, যশোর।

২. নির্বাচন কমিশন অফিস।
৩. যশোর নতুন পৌরসভা।

৪. সার্কিট হাউজ, সদর, যশোর।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানঃ
১. ঈদগাহ ময়দান, সদর, যশোর।
২. রামকৃঞ আশ্রম, রেলরোড, যশোর।
৩. ক্যাথলিক চার্চ, সদর, যশোর।
৪. চৌরাস্তা জামে মসজিদ।
৫. মাড়োয়াবাড়ি রাম কৃশ্ন মন্দির (মেড়ে মন্দির নামে পরিচিত)।
৬. এইচ,এম,এম,রোড জামে মসজিদ।
৭. সিদ্ধেস্বরী কালিবাড়ি মন্দির।
৮. বেজপাড়া পুজার মাঠ।
৯. নীলগঞ্জ মহাশ্বষান।

১০. চাচড়া শিব মন্দির।

১১. আঞ্চলিক পার্সপোর্ট অফিস।

সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানঃ
১. জেলা শিল্পকলা একাডেমি।
২. উদীচী।
৩. সুরবিতান।
৪. সুরধ্বনি
৫. বিবর্তন।
৬. পুনশ্চ।

বিখ্যাত ব্যক্তি বর্গঃ
১. সনাতন গোস্বামী (১৪৮০—১৫৫৮)।
২. রুপ গোস্বামী (১৪৮৯—১৫৫৮)।
৩. শ্রীজিব গোস্বামী (১৫১৩)
৪. সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৩৮—১৮৭৮)
৫. মাইকেল মধুসুধন দত্ত (২৫শে জানুয়ারী ১৮২৪—২৯শে জুন ১৮৭৩) উনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙ্গালি কবি ও নাট্যকার।
৬. বিরন চন্দ্র মুখোপদ্ধায় (১৮৯৩—১২ডিসেম্বর১৯৫৪) ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধি স্বাধীনতা আন্দলনের অন্যতম ব্যাক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবি।
৭. ফররুখ আহমেদ (১০ই জুন ১৯১৮—১৯শে অক্টবর ১৯৭৪) মুসলিম রেনেসার কবি।
৮. গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭—১৯৬৪) মুসলিম রেনেসার কবি।
৯. আবুল হোসেন (১৫ই আগষ্ট১৯২২—২৯শে জুন ২০১৪) মুসলিম কবি।
১০. এস. এম. সুলতান (১০ই আগষ্ট ১৯২৩—১০ই অক্টবর ১৯৯৪) প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী।
১১. ড. লুৎফর রহমান (১৮৯৭—১৯৩৬) প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও মানবতাবাদী।
১২. বাঘা যতিন ভারতের ব্রিটিশ বিরোধি স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যাক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী।
১৩. ইলা মিত্র (১৮ই অক্টবর ১৯২৫—১৩ই অক্টবর ২০২২) বিপ্লবী এবং সংগ্রামী কৃষক নেতা।
১৪. কমরেড অমল সেন (১৯শে জুলাই ১৯১৩—১৭ই জানুয়ারী২০০৩) তে ভাগা আন্দোলনের অন্যতম স্বক্রিয় নেতা।
১৫. রাধা গোবিন্দ চন্দ্র (১৭ই জুলাই ১৮৭৮—৩রা এপ্রিল১৯৭৫) জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
১৬. মুন্সি মেহেরুল্লাহ।
১৭. রাজা প্রতাপাদিত্য।
১৮. ড. শমসের আলী।
১৯. সুচন্দা অভিনেত্রী।
২০. ববিতা অভিনেত্রী।
২১. চম্পা অভিনেত্রী।
২২. প্রনব ঘোষ (জন্ম ১৯৫০) সুরকার।
২৩. মিনু রহমান (জন্ম১৯৫০) অভিনেত্রী।
২৪. হাসান কন্ঠশিল্পী।
২৫. কাজল (জন্ম১৯৬৭) কৌতুক অভিনেতা।
২৬. প্রফেসর শরীফ হোসেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
২৭. জ্যোতিস্ক বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্রঃ
২৮. বেগম আয়েশা সরদার (নারী আন্দোলনের নেত্রী)
২৯. মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন (অবিভক্ত বাংলায় তৎকালীন যশোর জেলায় মুসলমানদের অগ্রযাত্রা সবিশেষ অবদান রাখেন)
৩০. ওয়াহেদ আলী আনসারী (যশোর গেজেট প্রত্রিকার প্রকাশক, মুসলিম একাডেমী ও যশোর হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা)
৩১. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নন্দিতগবেষক ও আধুনিক বাংলা কাব্যের উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব প্রাবন্ধিক অর্নিবাণ, নির্বাচিত গান তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ)
৩২. আনোয়ারা সৈয়দা হকঃ (বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আনোয়ারা সৈয়দা হক এঁর রচনাবলীর মধ্যে অন্যতম হলতৃষিতা, সোনার হরিণ, তৃপ্তি, হাতছানি, মুক্তিযোদ্ধার মা, ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্যগ্রন্থ)
৩৩. মোঃ সফি, আলোকচিত্রকর মোঃ সফি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরবর্তীকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর দালিলিক সাক্ষী।

শিক্ষাঃ

যশোর শিক্ষাবোর্ড ছাড়াও আরো উল্লেখ্যোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে এই জেলায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ঃ

১. যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়।

 

২. যশোর মেডিকেল কলেজ।

৩. আদ—দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজ।

কলেজঃ


১. সরকারী এম. এম. কলেজ (মাইকেল মধু সুধন দত্ত কলেজ)


২. সরকারী সিটি কলেজ।


৩. সরকারী মহিলা কলেজ।


৪. শিক্ষা বোর্ড স্কুল এন্ড কলেজ।
৫. বিএ, এফ শাহীন কলেজ।
৬. ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক মিউনিসিপাল কলেজ।

কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ
১. যশোর পলিটেকনক ইনস্টিটিউট, যশোর ।
২. বিসিএমসি প্রকৌশল প্রযুক্তি মহা বিদ্যালয়, যশোর ।
৩. বাংলাদেশ টেকনিক্যাল কলেজ, যশোর।

বিদ্যালয়ঃ

১. যশোর জিলা স্কুল।


২. যশোর সরকারি বালক বিদ্যালয়।
৩. যশোর পুলিশ লাইন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।


৪. মনিরামপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়।
৫. মনিরামপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
৬. নারকেল বাড়ীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
৭. নব কিশলয় প্রি—ক্যাডেট নার্সারী স্কুল।

বিখ্যাত খাবারঃ

১. জামতলার সাদেক গোল্লা, শার্শা।

 

২. যশোরের বিখ্যাত খেজুরের গুড়।

৩. জল মোগের সকালের নাস্তা, অভিজাত রেষ্ট্রুরেন্ট, সদর, যশোর।
৪. জনির সন্ধ্যার কাবাব (চার খাম্বার মোড়)।
৫. বিলাতী মদের দোকান (রেল রোড)।
৬. ধর্মতলা দুধ চাঁ, সদর, যশোর।
৭. দেবু সুইটস এর বিখ্যাত রসমালাই, দই ও সন্দেষ, চাচড়া শিব মন্দির।
৮. অনন্য ঘোষ ডেয়ারির মিষ্টি, কোর্ট চত্বর।
৯. যশোর পৌরসভার পার্শে ১ টাকার সিজ্ঞাড়া।
১০. দুলালের পারফেক্ট লাল চাঁ (চার খাম্বার মোড়)।
১১. ২ টাকার ডাল পুরি রেল—রোড আদ—দ্বীন হাসপাতালের পাশে।
১২. ঝিকর গাছার কবিরের হোটেল (টাটকা তাজা মাছ ও মাংশ)
১৩. অসংখ্য ক্যাফে ডে লাইটের হট কপি ও চিকেন, বার্গার।

 

স্থানীয় পত্রিকা ও প্রকাশনাঃ
১. দৈনিক গ্রামের কাগজ।
২. দৈনিক সমাজের কথা।
৩. দৈনিক লোকসমাজ।
৪. দৈনিক স্পন্দন।
৫. দৈনিক সমাজের কাগজ।
৬. দৈনিক সত্য পাঠ।
৭. দৈনিক রানার।
৮. অনলাইন প্রকাশিত মিডিয়া নিউজবিডিজিার্নালিষ্ট২৪ 

ব্যাংক ও এনজিওর ভুমিকাঃ
যশোর প্রাচীনকাল থেকেই ব্যাবসা বানিজ্য অগ্রসর। যার ফলে অর্থনৈতিক ভাবে বিভিন্ন ব্যাংক ব্যাবসা করছে।যশোরের সঞ্চয়ী জনগনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যাবসায়ীদের ঋন হিসাবে প্রদান করছে এবং উন্নয়নের অংশিদার হচ্ছে।এছাড়া বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋন দিয়ে সাহায্য করছে।যশোরের দরিদ্র জনোগোষ্টিকে অর্ত সামাজিক উন্নয়নে এনজিওর ভিতর জাগরনী চক্র ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, আশা, আদ—দ্বীন, আর,আর,এফ এছাড়াও আরো অনেক উল্লেখযোগ্য এনজিও আছে।

মনিরামপুর উপজেলার ইতিহাস:


মনিরামপুর বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। জনশ্রুতি আছে রাজা সীতারাম রায়ের উকিল মুনিরাম রায়ের নাম ধরে জনপদেরনাম হয়েছে মনিরামপুর। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দশকে চাঁচড়া রাজবাড়ীর জনৈক মহিলা এখানে একটি মস্ত বড় পুকুর খনন করেন। আজও তা কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে।
বিভাগঃ খুলনা বিভাগ।
জেলাঃ যশোর জেলা।
আসনঃ ৮৯.যশোর—৫।
আয়াতনঃ মোট ৪৪৪.৭৩ কিমি ২ (১৭১.৭১ বর্গমাইল)
জনসংখা (২০১১) [১] মোট ৩৮২৪৬৫ ঘনত্ব ৮৬০/ কিমি(২২০০/বর্গমাইল)
স্বাক্ষরতার হার মোট ৫০.৭৬%
পোস্ট কোড ৭৪৪০
মনিরামপুর বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এটি বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ উপজেলার মধ্যে অন্যতম।

প্রশাসনিক এলাকাঃ
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা মনিরামপুর। এর আয়াতন ৪৪৪.৭৩ বর্গ কিল্লোমিটার (১৭১.৭৩ বর্গমাইল)। উত্তরে যশোর উপজেলা, পূর্বে অভয়নগর উপজেলা, দক্ষিনে কেশবপুর উপজেলা এবং পশ্চিমে সাতক্ষীরা উপজেলার কলারোয়া উপজেলা ও ঝিকরগাছা উপজেলা।

প্রধান নদ—নদীঃ
হরিহর, মুক্তশ্বরী, কপোতাক্ষ, ঐতিহ্যবাহী ঝাঁপা বাওড়।

জনসংখা:
৩৮২৪৬৫ জন। পুরুষ ১৯৫৩৩৮ জন, মহিলা ৮৭১২৭ জন। মনিরামপুর উপজেলা ১৯৮৩ সালে গঠিত হয় এবং প্রথম উপজেলার চেয়ারম্যান হয় রাজগঞ্জের হানুয়ার গ্রামের কৃতি সন্তান লুৎফর রহমান এবং বনার্তদের ত্রান দিতে যেয়ে গাড়ী এক্সিডেন্টে নিহত হন। বর্তমান এখানে ১টি পৌরসভা, ১৭টি ইউনিয়ন, ২৪৯ টি গ্রাম আছে।

ইউনিয়নঃ
০১। রোহিতা ইউনিয়ন
০২। কাশিমনগর ইউনিয়ন
০৩। ভোজগাতী ইউনিয়ন
০৪। ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন
০৫। হরিদাসকাটি ইউনিয়ন
০৬। মণিরামপুর ইউনিয়ন
০৭। খেদাপাড়া ইউনিয়ন
০৮। হরিহরনগর ইউনিয়ন

০৯। ঝাঁপা ইউনিয়ন
১০। মশ্বিমনগর ইউনিয়ন
১১। চালুয়াহাটি ইউনিয়ন
১২। শ্যামকুড় ইউনিয়ন
১৩। খানপুর ইউনিয়ন
১৪। দূর্বাডাংগা ইউনিয়ন
১৫। কুলটিয়া ইউনিয়ন
১৬। নেহালপুর ইউনিয়ন
১৭। মনোহরপুর ইউনিয়ন

রাস্তাঘাট ও যানবাহনঃ
মনিরামপুর উপজেলায় প্রায় ৪৪ কিমি পাকা, ৩২ কিমি সেমি পাকা, এবং ৭৮৬ কিঃমিঃ অবহেলিত কাচা রাস্তা আছে যা পায় হেটে চলারও অনুপোযোগী। ঐতিহ্যবাহী যান বাহন বায়া, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, রিক্সা—ভ্যান, টেম্পু, করিমন, টেকার, নসিমন, আলমসাধু এবং ইজিভ্যান, অটোরিক্সা সহ অন্যান্য সাধারণ যানবাহন রয়েছে।

স্থানীয় সংগঠনঃ
অভেদ রক্তদান সংস্থা, প্রত্যয়, সমাজ উন্ন্যন্মুল্ক সংগঠন, সত্যসন্ধ, কন্ঠশীলন, উচ্চরণ শিল্পী সংসদ, মনিরামপুর শিল্পী গোষ্ঠি, ফ্রেন্ড সার্কেল ব্লাড ফাউন্ডেশন, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন।

 

 

 

 

 

উৎসবঃ
বৈশাখি মেলা বই মেলা মনিরামপুর শিল্পী গোষ্ঠির আয়োজনে ২০০০ সাল থেকে নিয়মিত এই বইমেলা হয়ে থাকে। মনিরামপুর পাইলট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে সাধারণত এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কৃষি মেলা বৃক্ষ ও ফলজ মেলা পূজা ও পার্বন মশিয়াহাটি এর মন্দির প্রাঙ্গন এর দূর্গাপুজা অন্যতম চমকপ্রদ। তাছাড়া কপালিয়া মহামায়া পূজা (গাউটে মেলা) এর মেলা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
জনসংখ্যার উপাত্ত শিক্ষা।

অর্থনীতিঃ
এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান শস্যগুলোর মধ্যে ধান, পাট, গম, আলু ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়া শিল্পকারখানার দিক দিয়ে মনিরামপুর খুব একটা উন্নত না হলেও এখানে কিছু কলকারখানা রয়েছে। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে আম, কাঠাল, কলা সহ অন্যান্য ফল পাওয়া যায় আর সেগুলো বিভিন্ন জেলায় রপ্তানীও হয়। এই অঞ্চলের মানুষের জীবিকা মুলত কৃষিনির্ভর। সম্প্রতি অত্র অঞ্চলে মাছের চাষে তুলনামুলক অগ্রগতি হবার কারনে মানুষের জীবন জীবিকা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

দর্শনীয় স্থানঃ
পাগলাদোহা, অচিন গাছ, দমদম পীরের ঢিবি। নিজশ্ব অর্থায়নে দেশের বৃহত্তম ড্রামের ভাসমান সেতু দুইটি ঝাঁপা বাওড়ের উপর বর্তমানে প্রস্তাবিত পর্যটক এলাকা।

ঝাঁপা জনপদের ইতিকথাঃ


বাওড় শব্দের আভিধানিক অর্থ নদীর বাক। কোন স্রোতাস্বিনী নদীর স্রোতধারা দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যে অংশটি মুলস্রোত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ওই অংশকে বাওড় বলা হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী গুলির উৎস হলো ভারতে। প্রবাহমান নদী পথ পরিক্রমায় শত—শত মাইল অতিক্রম করে। কালের পরিবর্তনে বিভিন্ন কারণে সকল প্রবাহমান নদীর অংশ বিশেষ অঞ্চল ভিত্তিতে মুল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাওড়ের জন্ম দেয়। এ কারনেই বাংলাদেশের অসংখ্য বাওড়ের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহমান নদীগুলো সারাদেশে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ঐ সকল নদীবাহিত পলি দ্বারা বাংলাদেশ গঠিত। তাই বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ট “ব” দ্বীপ। নদীবাহিত পলি দ্বারা ভুমি গঠন প্রক্রিয়া শেষ করে নদীর মরে যাওয়াই নদীর ধর্ম। হিমালয়ের সংস্পর্শে নদীগুলি সমগ্র বাংলার ভুমি গঠন প্রক্রিয়ার কাজ অবিরাম করে চলেছে। সমুদ্রের জোয়ার, পলি প্রক্ষেপণ ও ভুমি কম্প নদীর স্রোত—ধারার দিক পরিবর্তনের অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে সংযোগ খালের মাধ্যমে নদীর দিক পরিনর্তন করা যেতে পারে। গঙ্গা নদী থেকে ভৈরব ও কপোতাক্ষের নন্ম। ভৈরব ও কপোতাক্ষের সংস্পর্শে প্রায় ৩৯ ট ছোট—বড় বাওড়ের সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে ঝাঁপা বাওড় দ্বিতীয় বৃহত্তম। ঝাঁপা বাওড় থেকে দক্ষিনে মাত্র আধা কিঃমিঃ গেলেই অনুরূপ মশ্নিনগরের পারখাজুরা বাওড় চোখে পড়ে। যশোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ দক্ষিনে মনিরামপুর উপজেলা। এখান থেকে প্রায় ১৫ কিঃমিঃ পশ্চিমে রাজগঞ্জ বাজার ও ঝাঁপা বাওড় অবস্থিত। আর এই ঝাঁপা মনিরামপুর উপজেলার ৯নং ঝাঁপা ইউনিয়ন। এই ঝাঁপা বাওড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিঃমিঃ এবং প্রস্থ প্রায় ১কিঃমিঃ। বর্তমানে বাওড়ে আয়াতন ৬৪০ একর। মুল জলাশয়ের গড় গভীরতা ১৪/১৫ফুট (বর্তমান)। ঝাঁপা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লিঃ বাওড়ে পরকল্পিত মৎস্য চাষ করে থাকে। বার্ষিক মাছের উৎপাদন প্রায় ২৫০ টন (বর্তমানে)। রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, মিনার কার্প, সিলভার কার্পসহ প্রাকৃতিক ভাবে প্রচুর বিলমাছ এখানে জন্মে। মৎস্যজীবি সমিতির সংগে এলাকার আরো প্রায় ৩০০জন সদস্য সংশ্লিষ্ট এই বাওড় এর নামে বার্ষিক প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা (সম্ভাব্য) রাজস্ব খাতে জমা দেয়। যশোর জেলা প্রশাষকের কার্যলয় থেকে বার্ষিক বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বাওড়ের উত্তর—পুর্ব পাড়ে রাজগঞ্জ বাজার গড়ে উঠেছে। বাওড় সৃষ্টির পুর্বে কপোতাক্ষ নদের এই অংশে দেশ বিদেশ থেকে ব্যাবসায়ীরা এসে ব্যাবসা—বানিজ্য করতো। মাড়োয়ারীরা নৌপথে এখানে ব্যাবসা—বানিজ্যের জন্য আসতো। মাড়োয়ারীরা ভুষিমাল ও তামাকের ব্যাবসা করতো। মাড়োয়ারীদের মধ্যে লক্ষীচাঁদ ক্যাছড় ও মুরারী ধর ক্যাছড়ের নাম এলাকার অনেকেই মনে করতে পারেন। ১৮০০ সালে এখানে রেজিষ্ট্রী অফিস ও পুলিশ ব্যারাক ছিল। ১৯০০ সালে এখান থেকে রেজিষ্ট্রী অফিস উঠে যায়। ইংরেজ আমলে এই এলাকায় নীল কুঠি ছিল ও নীল চাষ হতো। মানিকগঞ্জ ব্রীজ থেকে রাজগঞ্জ বাজার পর্যন্ত পুরো এলাকাটি ছিল নীল কুঠি ও কুঠিয়ালদের বসবাসের স্থান। ব্যাবসায়ী ও কুঠিয়ালদের বসবাসের ফলে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে উঠেছিল বাঈজী বাড়ী। এখানে যে সকল বাঈজী ছিল তাদের নাম গোলাপী, চারুবানু, হাসিরাণী প্রমুখ। গভীর রাত থেকে সারারাত এখানে নাচ—গান হতো। আজও গোলাপীর বাড়ীর নাচ মহল ও তোরন অক্ষত আছে।
বর্তমানে গোলাপীর বাড়ীটি ঝাঁপা গ্রামের হাজী আঃসাত্তার সাহেবের মালিকাধীন আছে।
ঝাঁপা গ্রামটির প্রায় চার পার্শ্ব ঘিরে রেখেছে ঝাঁপা বাওড় এবং ১৭৪নং মৌজার একটা উপ—দ্বীপ। গ্রামটির আয়াতন ৩১৫১ একর। বাওড়ের চতুর্পার্শ্বের গ্রামগুলি হলো কোমলপুর, হানুয়ার, মশ্নিমনগর, ডুমুরখালি, লক্ষিকান্তপুর, মল্লিকপুর, রামপুর ও মোবারকপুর। এই গ্রামগুলির মধ্যে হানুয়ার একটি শিক্ষিত গ্রাম হিসেবে পরিচিত। মশ্নিমনগর গ্রামের সুসন্তান নজরুল ইসলাম খাঁন সাহেব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব ছিলেন কিছুদিন সে অবসরে আছেন। উল্লেখিত গ্রামগুলির প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরক্ষভাবে বাওড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দৈনন্দিন প্রয়োজন, ব্যাবসা—বানিজ্য, কৃষি মৎস, জলবায়ুতে বাওড় এর সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাওড়ের পশ্চিম উত্তর কোনে ঝাঁপা বাজার, যার পূর্বেকার নাম ছিল ফৈতিয়ার হাট।
ঝাঁপা গ্রামের নামকরনঃ
ঝাঁপা গ্রামের নামকরন মিয়েও রয়েছে কয়েকটি অভিমত।
নিম্নে অভিমত গুলো তুলে ধরা হলোঃ
১. ঝাঁপা গ্রামের রায় বংশীয়রা এই গ্রামের প্রথম বসত স্থাপনকারী।তাদের পূর্ব পুরুষ বাঁসিরাম রায়(?) তিনি নদী পথে খড়ের গাঁদা ধরে (অজ্ঞাত) কোন এক এলাকা থেকে ভেসে এসে কপোতাক্ষ নদী ঝাঁপিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ ভু—খন্ডে উঠেছিলেন বলে ঐ ভু—খন্ডের নাম ঝাঁপা।
২. কপোতাক্ষের এই ঘুরপথ অংশের বহিরভাগে উপরোল্লিখিত গ্রামের লোকজনকে নদীর মধ্যভাগে ভু—খন্ডে পৌছানোর জন্য ঝাঁপিয়ে নদী পার হতে হতো সেই কারণে ঐ ভু—খন্ডের নাম ঝাঁপা।
৩. বর্তমান ঝাঁপায় বসবাসকারী রায় বংশের পূর্ব পুরুষ ঝাঁপায় প্রথম বসতিস্থাপনকারী বাঁসিরাম রায় (?) তাদের জমিদারী অঞ্চলে কোন অজ্ঞাত কারণে ইংরেজদের বিরাগভাজন হন। সেই জন্যে তাকে ইংরেজরা বন্দী করে নৌযানে কপোতাক্ষ নদ দিয়ে কাসিমবাজার কুঠিতে নিয়ে যাচ্ছিলো। বন্দী অবস্থায় সুযোগ বুঝে রাতের আধারে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে একটি খড়ের গাদা ধরে ভু—খন্ডে পৌছায়। জঙ্গলাকীর্ণ এই ভু—খন্ডে কিছুদিন আত্নগোপন করে নিজ এলাকার মানূষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ নিয়ে গ্রাম গড়ে তোলেন। আর এই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়াকে কেন্দ্র করে ঐ ভু—খন্ডের নাম হয় ঝাঁপা।
৪. বখতিয়ার খলতির বঙ্গ বিজয়ের পর সিন্ধু অঞ্চল হাজ্জাজ—বিন ইউসুফের বংশধর কতিপয় অনুচরসহ নদী ঝাঁপিয়ে ঐস্থলভাগে উঠেছিল বলে এ ভু—খন্ডের নাম হয় ঝাঁপা।
ঐতিহাসিক সত্যতা কতটুকু রক্ষা করেছেন সেটা জানার প্রয়োজনে কিছুটা। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতব্দীর প্রারম্ভে বখতিয়ার খিলজি সেন রাজাদের নিকট থেকে গৌঢ় ও রাঢ় জয় করেন। তখন যশোর জেলাটু প্রাচীন সমতট জনপদের অংশ ছিল। অর্থাৎ যশোর জেলাটি বখতিয়ারের বিজিত অঞ্চলের ভিতর ছিল না। এই সময় সিন্ধু অঞ্চল থেকে হাজ্জাজ—বিন ইউসুফের বংশধর ফকির ত্বকী নামক আউলিয়ার বাংলাদেশের দক্ষিন—পশ্চিম অঞ্চল ঘুরে অনুচরনসহ ঝাপিয়ে কপোতাক্ষ নদী পার হয়ে এখানে এসে আস্তানা গাড়া সম্পর্কিত তথ্য কোন ইতিহাস গ্রন্থ বা বই পুস্তক থেকে সমর্থিত হয়নি।দক্ষিন—পশ্চিম অঞ্চলে আগত ইসলাম প্রচারকদের নামের তালিকায়ও এই নামের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়নি। এই নামের কোন ব্যাক্তি ঝাঁপা অঞ্চলের জনপদ ইসলাম প্রচার করেছেন এমনো শুনা যায় না। কথিত দরবেশের আস্তানার আশে—পাশে মসজিদ, দরগা, মাজার, খানকা এমন কোন স্থাপনারো খোজ পাওয়া যায়নি। শাসক শ্রেণীর সম্পৃক্ততায় যারা ইসলাম প্রচার করেছেন,তাদের নামের সঙ্গে “শাহ”খান” বা খাঁ উপাধি জড়িয়ে আছে। যেমন সাঈদ শাহ, শাহ কারারিয়া, ফতে খাঁ, শাহ জালাল, খাকি শাহ। ফকির উপাধি তাদের ভিতরে দেখা যায় না। তবে ঝাঁপার হাটের পূর্ব নাম, ফৈতিয়ার হাটকে কেন্দ্র করে হাজ্জাজ বংশীয় দরবেশের কথা যারা বলেছেন, তারা এ কাজটি করেছেন।
এই কাল্পনিক বিষয়টি সাধারণ জনগনের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান আমরা শুনেছি প্রবীণ লোকদের মুখ থেকে স্কুল জীবনে একটি লিফলেট থেকে তথ্যটি জানতে পেরছে।
আমার মনে হয় এখনও গ্রামে—গঞ্জে, হাটে বাজারে মাঝে মধ্যে কিছু অজানা—অচেনা লোক দেখতে পাওয়া যায়। এদের অধিকাংশ বিকৃত সুফি মতাদর্শের মানুষ। সেই কারণে ফকির তকীর হাট’ সংক্ষেপে ফৈতিয়ার হাট ‘হতে পারে।তবে এ বিষয়টিও গ্রামের প্রবীণ লোকদের দাবী।
গালিব হরমুজ তার ‘ঐতিহাসিক যশোর’ গ্রহন্তে ঝাঁপা বাঁওড় সম্পর্কে একটি জলশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছেন।
জলশ্রুতিটি নিম্নরুপঃ
‘অনেকদিন আগে জনমানভীন এলাকা অর্থাৎ বাওড়ের তীরে ছিল কোন এক গোয়ালার বাড়ি।তার ছিল অনেকগুলো গরু। ঐসব গরুর দুধ দোহন করে রেখে দিত বড় ধরণের পাত্রে। পরবর্তীতে কোন লোক এসে দুধ চাইলে ঐখান থেকে বালতিতে তুলে দুধ বিতরণ করত। সেদিন এক ব্যাক্তি দুধ চাইলে তাকে দেয়নি। না দেওয়ার কারণও ছিল।লোকটার গতিবিধি সন্দেহ বিবেচনায় দুধ না দিয়ে বঞ্চিত করে। দুধ না পেয়ে ফকির ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোয়ালার গরু গুলো ঝাঁপ দেয় বাওড়ের অথৈ পানিতে। এর পরে আর কোনদিন গরুগুলো উঠে আসেনি।কয়েকদিন পরে গোয়ালাও অদৃশ্য হয়ে যায়। লোকেরা অনেক অনুসন্ধান করেও তার কোন হদিস পায়নি। তখন থেকে বাওড়ের নামকরণ হয় ঝাঁপা বাওড়।
যুগ—যুগ অতিক্রম করেও এ নামের কোন পরিবর্তন হয়নি।
একটি অসমর্থিত সুত্র থেকে জানা যায় ঝাঁপা বাওড় সৃষ্টিতে প্রকৃতির সাথে মানুষের সংশ্লিষ্টতা আছে সুত্রটি আরো জানায় ঐ বাওড় তৈরীতে ইংরেজদের তথা কুঠিয়ালদের হাত রয়েছে। ঝিকরগাছা কনসার্ন এর যাবতীয় যোগাযোগ এর মাধ্যম ছিল কপোতাক্ষ নদ। এই নদের ঘুর পথের অংশটি প্রায় ১২কিঃমিঃ। এই ঘুরপথটি অতিক্রম করতে ইংরেজদের প্রায় অর্ধেক সময় চলে যেতো। তারা নৌপথ সংকিপ্ত করে সময় বাঁচানোর জন্য সংযোগ খালের মাধ্যমে নদীর গতি পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করে। কপোতাক্ষের খরস্রোত তাদের এ কাজে উৎসাহিত করে। নদীর গতি পরিবর্তনের জন্য তারা বর্তমান ঝাঁপার হাটের (ফৈতিয়ার হাট) পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে ৮০০/৯০০ ফুট কেটে দিয়ে নদীর সঙ্গে সংযোগ দেয়। ফলে কপোতাক্ষের মুলস্রোত খাড়াভাবে ভাটিতে মুলনদীর সঙ্গে মিলিত হয়। ধীরে ধীরে বাঁকের জোয়ার ও ভাটার উৎস মুখে পলি জমে পুরো বাঁকটি বাওড়ে পরিণত হয়।
ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে পূর্ব থেকেই ঝাঁপা অঞ্চলের জনগণের উপর প্রশাসনিক প্রভাব কিছুটা শিথিল। সেই জন্য যে বা যারা নিজেদেরকে প্রশাসন থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতে চাইতেন এবং তারা ঐ অঞ্চলে অবস্থান করতেন। এখানকার শান্তিপ্রিয় মানূষরা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতেন।
এ কারণেই রায় বংশের সর্বকনিষ্ঠ বংশধর পঞ্চানন রায় ঝাঁপা ছেড়ে কেশবপুর উপজেলার মাদারডাঙ্গা (পাজিয়া) এসে বসবাস করতেন বলে পঞ্চাননের সদ্যবিধবা স্ত্রী আরতি রায় জানান। একই কারণে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঝাঁপা জনপদের গুরুত্ব ছিল অনেক। ঝাঁপা এলাকার হানুয়ার গ্রামের বীর মুক্তিযুদ্ধা আঃসামাদ জানান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই গ্রামটি প্রায় মুক্ত ছিল।
তবে পাকশেণাদের হাতে অনেকে লাঞ্চিত হতে হয়েছে এমনকি ঝঁপা গ্রামের ঐ সময় সবচেয়ে শিক্ষিত ছিল মৌলভী মুহাঃ আজহারুল ইসলাম ও তাদের হাতে মাইর খেয়েছে এমনকি মাজায় আঘাত ও পেয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেই মাজার ব্যাথা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেন। এই এলাকাটি যুদ্ধকালীন যোগাযোগ ও সরবরাহ লাইনের জন্য গুরুত্বপুর্ণ ছিল। তখন রাজগঞ্জ হাই স্কুলে রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এক যুদ্ধে মুক্তিসেনারা ক্যাম্পটি দখল করে নেই এবং রাজাকারদের হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধগুলোর ভিতর ডুমুরখালীর যুদ্ধটি ছিল বড় যুদ্ধ। যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় কয়েকজন খান সেনা আহত হলে খান সেনারা পালিয়ে যায়।

ভাসমান সেতুঃ
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার একটি বাঁওড় তার নাম ঝাঁপা বাওড়। বাওড়ের এ’পাড়ে রাজগঞ্জ বাজার আর ঐ’পাড়ে ঝাঁপা (বাঁওড়ের নামেই এর নাম) গ্রাম। গ্রামটিতে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার লোক বসবাস করে। প্রতিদিনই নানা কারনে তাদের এ’বাওড় পার হয়ে রাজগঞ্জ বাজারে যেতে হয়। গ্রামটির চার দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে এ’বাওড়। এ’টি শুধু একটি মৌসুমের কথা নয়, সারা বছরই তাদের পার হতে হতো এ বাওড়। ফলে শত বছর ধরে যোগাযোগ সংকটে ভুগছিল গ্রামটির মানুষ। নৌকা ছিল বাওড় পারাপারের একমাত্র উপায়। নৌকা পাওয়া না গেলে মুল লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতো গ্রামটি। যোগাযোগের এই সংকট নিয়ে বেশ কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও ঘটেছে এই গ্রামে। পারাপারের সময় ২০১৪ সালে স্কুলশিক্ষাত্রীসহ নৌকা ডুবে, পানিতে পড়ে একশিশুর মৃত্যু ঘটেছিল। সময় মত নৌকা না পাওয়ার কারনে অনেক মূমূর্ষ রুগীর মৃত্যুও ঘটেছে এই গ্রামে তার মধ্যে সর্দার পাড়ার ডাক্তার আজিবারের বড় ছেলে শামছুর রহমানও একই কারনে মৃত্যু বরন করেছিলেন।
ঝাঁপা বাঁওড়ের ভাসমান সেতুর ইতি কথাঃ
“একতায় বল”

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”—কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের গানের এই চরণটি বহু শ্রুত। আবার অনেকেই হয়ত অনুসরণও করি। তবে এবার তো অনুসরণ করলো ঝাঁপা গ্রামের অধিবাসীরা। ঝাঁপা গ্রামবাসীর ডাক শুনেনি প্রশাসন, বিত্তবান বা ক্ষমতাধর কোন ব্যাক্তি। তাই বলে ঝাঁপা গ্রামবাসী আর বসে থাকেনি। তাদের নিজ উদ্যোগে তৈরী করেছে দীর্ঘ ও অভিনব এক ভাসমান সেতু। ইতি মধ্যে অনেকেই জেনে গেছে ভাসমান সেতুটির কথা। গ্রামবাসীর উদ্যোগ ও সেতুটি নিয়ে বিস্তারিত থাকছে আমার এই লেখায়।
পরিকল্পনাঃ
প্রায় ছয় বছর আগের কথা, বাঁওড়ের পাশে বসে স্থানীয় মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক মোঃ আসাদুজ্জামান কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলেন। তখন স্যালো মেশিন দিয়ে বাঁওড় থেকে বালু তোলা হচ্ছিল, মেশিনটি বসানো হয়েছিল কয়েককটি প্লাষ্টিকের ড্রামের উপর বাঁশের ফ্রেম বানিয়ে তার উপরে। যাতে পানিতে ভেসে থাকে এ’টি। এ’রকম একটি ভারী মেশিনটি এই পদ্ধতিতে ভাসতে দেখে হঠাৎ তার মাথায় আসে একটি সেতুর কথা। তিনি ভাবলেন, একই পদ্ধতিতে যদি ড্রামের সাহায্যে সেতু তৈরী করা হয় এটিও তো নিশ্চয় ভাসবে। তখন প্রথমে আমাদের গ্রামের আকছেদের ছেলে লিটন, শফিকুজ্জামান (সাজু), মাষ্টার মেহেদী হাসান(টুটুল), এদের সাথে পরামর্শ করতে থাকে হঠাৎ একদিন রাতে গ্রামের মোশাররফের সাথে লিটন প্রস্তাব দিলো বাওড়ে সেতু করতে হবে তখন মোশাররফ বলে উঠলো সেটা কি করে সম্ভব? তখন লিটন বল্লো সম্মতি থাকলে করা সম্ভব এর পরে মোশাররফের নিকট থেকে ও সম্মতি পেয়ে মাষ্টার আসাদকে গ্রামের সবার সাথে কথা বলতে বলে। এরপর আসাদ গ্রামের মানুষের সাথে আলোচনা শুরু করে দিল এ’বিষয়টি নিয়ে, সকলেরই সম্মতি দেলে তার এই পরিকল্পনায়। এর পরে গ্রামবাসির সাথে কয়েক দফা আলোচনা করার পরে গঠন করেন ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। আর জমা করতে লাগলো মাসে মাসে ফান্ডে টাকা প্রথম অবস্থায় সদস্য হলো মাত্র ২৮ জন এভাবে শুরু হলো যাত্রা। যদিও সেতুটি তৈরী করতে লেগেছে কয়েক মাস। গ্রামবাসীর সাথে বৈঠকের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। সরকারি বা রাজনৈতিক কোন প্রকার আর্থিক সাহায্য ছাড়ায় শুরু হবে সেতুর কাজ। এরপরে আস্তে আস্তে সদস্য বাড়িয়ে মোট ৬০ জন হলো। এরপরে গ্রামের এই ৬০ জন দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত যুবককে নিয়ে গড়ে তোলা হলো পরিপূর্ণ ফাউন্ডেশন। ঐ ফাউন্ডেশনের প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে জমা নিয়ে সম্মিলিত ভাবে গঠন করা হলো সেতুর ফান্ড। সেতুটি তৈরীর ব্যাপারে মাষ্টার আসাদের সাথে সবাই যখন কথা বল্লো কিভাবে করতে হবে, তখন আসাদ বল্লো আমাদের কারো কারগরি জ্ঞান নেই। তবে গ্রামের ভাসায় বল্লো গাইতে গাইতে গায়েন এর মতো নিজেদের মাথা খাটিয়ে কাজটি করতে হবে আর এভাবেই শুরু হলো সেতুর কাজ। তবে কাজটি মুলত করেছে আসাদের পরামর্শে রাজগঞ্জের বিশ^াস ইঞ্জিনিয়ারিয় ওয়ার্কশফ এর সত্ত্বাধীকারী রবিউল ভাই, এ’বিষয়ে পরে লেখায় তুলে ধরা হবে।
যার নির্দেশনায় তৈরী হলো এ’সেতুঃ
রাজগঞ্জ বাজারে অবস্থিত বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে ওয়ার্কশফ। ওয়ার্কশফটি রবিউল ইসলামের। তেমন স্বচ্চলতায় কাটেনি রবিউলের শৈশব। অভাব আর অনাটনের কারণে মাধ্যমিকের পরে আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না থাকলেও মেধার জোর তার বরাবরই ছিল, এর সাথে ছিল ইচ্ছাশক্তি। তার এই ইচ্ছাশক্তি তীব্র ছিল বলেই স্বশিক্ষায় শিক্ষিত ক্ষুদ্র এক প্রকৌশলীতে পরিনত হয়েছে। ঝাঁপার বাঁওড়ের প্রথম ভাসমান সেতুটি তৈরী হয়েছে তারই নির্দেশনায়। নির্দেশনা কথাটি বললে কিছুটা ভুল হবে, সেতুটির কারিগরই তিনি। এর পরে তিনি ১০জন শ্রমিক নিয়ে সেতুর কাজ শুরু করেন, অল্প শ্রমিক দিয়ে কাজ করার কারণে একটু সময় বেশি লেগে গেছে। এই সেতুটি তৈরী করতে তিনি ৪,৮০,০০০/=(চার লক্ষ আশি হাজার টাকা) পেয়েছেন। তবে তার মতে তার শ্রমের মুল্য এর চেয়ে বেশি। শুধু কাজটি অর্থের জন্য নয় সুনাম এবং প্রচারের জন্য এই টাকায় করেছেন। সেতুটি তৈরী করতে দীর্ঘ চার মাস সময় লেগেছে।
ঝাঁপা গ্রামবাসীর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে সারা দেশের মানুষ। প্রতিদিন বহু মানুষ আসছে অভিনব এ’সেতুটি দেখতে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত কোন স্বীকৃতি পায়নি। দুর্নীতি, গুম, হত্যা, ধর্ষন, সন্ত্রাস, ব্যার্থ আন্দোলনের ভীড়ে যখন হতাশাগ্রস্থ এক অন্ধকারে আমাদের সামাজিক জীবন, তখন আশার আলো জ্বালার মতো স্বস্তিদায়ক একটি সংবাদ ছিল গ্রামবাসীর এ পদক্ষেপ। গ্রামবাসী প্রমান করে দিয়েছে, ইচ্ছা করলে নিজেদের সমাস্যার সমাধান গ্রামবাসী—ই করতে পারে। তবে গ্রামবাসীর এই উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী কোন সমাধান নয়। বর্ষা বা ঝড় আসলে বাঁওড়ের পানি বাড়ার সাথে সাথে স্রোত ও বাড়বে। তখন সেতুটির অবস্থান ও অবস্থা ঠিক রাখা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আর এক বর্ষা বা ঝড় পার করলেও পরবর্তীতে কি হবে? তাহা নিশ্চিত করে বলা যাবে না কাঠামোগত কারণে। গ্রামের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ যখন নিজ খরচে এমন মহৎ উদ্যোগ নিতে পারে তখন সরকারতো চাইলে এই গ্রামবাসীর জন্য একটি স্থায়ী সমাধান দিতেই পারে।
পরীক্ষা মুলকঃ
এই সেই ভাসমান সেতু। হঠাৎ করেই যে সেতুটি তৈরী করা হয়েছে, ব্যাপারটা মোটেই স্বাধারণ নয়। এর জন্য প্রথমে ছোট খাটো পরীক্ষা—নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল। একটি ২০ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট ফ্রেম তৈরী করে, তা ১৬টি প্লাস্টিকের ড্রামের উপর স্থাপন করা হয়। এটি সফলভাবে ৩২ জনকে নিয়ে ভাসতে সক্ষম হয়। এ’দেখে সাহস পায় গ্রামবাসী এবং বৃহৎ প্রকল্পের দিকে অগ্রসর হয়। এবার ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে সেতুটি তৈরীর কাজ শুরু হয়। নির্মান কাজে শ্রমিকদের পাশা—পাশি স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে গ্রামবাসী।
সেতুর খুটিনাটিঃ
লোহার বার দিয়ে তৈরি ফ্রেম বসানো হয়েছে দুই সারি প্লাস্টিকের ড্রামের উপর। ড্রামগুলো ফ্রেমের সাথে গোলাকার এঙ্গেল দিয়ে আটকানো আছে। দুই সারি ড্রামের মাঝে রয়েছে সামান্য ফাঁকা স্থান। ফ্রেমের উপর পাটাতন হিসেবে দেওয়া হয়েছে লোহার সিট। সেতুর দুই পাশে নিরাপত্তার জন্যে রয়েছে লোহার রেলিং। সেতুটি তৈরী করতে প্রায় ৫০০০০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ টাকা) খরচ হয়েছে ৫মাস সময় লেগেছে। সেতুটি ১০০০ ফুট লম্বা এবং ৮ফুট চওড়া। সেতুটিতে ৮৪০টি প্লাশটিকের ড্রাম,৮০০মন লোহার এঙ্গেল ও বার রয়েছে। সেতুটিতে আরো রয়েছে ২৫০টি চার ফুট প্রশস্ত লোহার সিট যুক্ত রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বাঁওড়ে পানি কিছুটা শুকিয়ে যায়, তাই সেতুর দুই পাশে যুক্ত করা হয়েছিল বাশের তৈরী ৩০০ ফুট সংযোগ সেতু(সেটি এখন আর নাই বর্তমানে রাস্তা করা হয়েছে)। সেতুটি দিয়ে ছোট যানবাহন যেমনঃ রিকসা, ভ্যান, নছিমন, মোটর সাইকেল, অটোরিকসা ইত্যাদি যাতায়াত করতে পারে।
সেতুর উদ্ভোধন ও নামকরণঃ
২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারী দীর্ঘ ১০০০ফুট ভাসমান সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় জেলা প্রশাষক জনাব আশরাফ উদ্দিন এবং ৯নং ঝাঁপা ইউনিয়নের সুযোগ্য চেয়ারম্যান জনাব মোঃ সামছুল হক (মন্টু) ভাই উদ্ভোধন করে জনস্বাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেন। এবং সেতুটির নাম দেন জেলা প্রশাসক ভাসমান সেতু। সেতুর সভাপতি মাষ্টার মেহেদী হাসান(টুটুল) এর সাথে কথা বলে জানা গেলো বর্তমান সেতুটির প্রশাষনিক সমাস্যার জন্য নাম পরিবর্তন করে পুনারয় ঝাঁপা বাঁওড় ভাসমান সেতু(অনাথের ঘাট) রাখা হয়েছে। এখন এর পর থেকে আনন্দের সাথে সেতুটি ব্যাবহার করছে গ্রামের মানুষ। ছোটখাটো যানবাহনও পার হচ্ছে সেতু দিয়ে। সেতু তো হয়েই গেলো,শত বছরের যাতায়াতের জনভোগান্তিরও অবসান ঘটলো, কিন্তু এবার প্রশ্ন নৌকা চালিয়ে যারা সংসার চালাতো তাদের কি হবে? তাদেরও ব্যাবস্থা করে দিয়েছে সদস্যরা তাদের চার জনের কাছ থেকে ৬০,০০০/= (ষাট হাজার টাকা) নিয়ে দুইটি সদস্যপদ দিয়েছে চারজনকে আদায়ের জন্য রেখে তাদের পারশ্রমিক দিচ্ছে তা দিয়ে তারা পূর্বের মত সংসার চালাতে সক্ষম হচ্ছে। আগে গ্রামবাসী মাঝিদের দপ্তাহে পাঁচ টাকা ও বছরে যে ধান দিতো নৌকা পারাপারের জন্য এখনো একই খরচে এই সেতু তারা ব্যাবহার করতে পারবে। কিন্তু অন্য এলাকার মানুষদের টাকা দিয়ে সগেও পার হতে হতো আর এখনো তাই—ই করতে হবে।
ভাসমান সেতু ও ঝাঁপার মানুষঃ
দূর থেকে দেখা যায় সবুজভাগ পানির উপরে ভাসমান নীল আর কমলা রঙের সেতুটি। কাছে গেলে দেখা যায় বাঁওড়ের পানিতে নীল আর কমলার প্রতিফলন। বেশ মনোরম এ দৃশ্য, প্রথম দেখায় যে কেউ ভাবতে পারে, বিদেশী কোনো কোম্পানি স্বল্প খরচে তৈরী করে দিয়েছে এ সেতুটি। আসলে তা নয় কোনো প্রকৌশল বা কারিভগরীজ্ঞান ছাড়ায় স্বল্পশিক্ষিত ঝাঁপা গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় তৈরী হয়েছে সেতুটি। ভাসমান এ’সেতু পালটে দিয়েছে এ’জনপদের চিত্র। সেতুটি হওয়ার ফলে আশেপাশের নয়টি গ্রামের মানুষের যোগাযোগের এসেছে আমূল পরিবর্তন। স্কুল, কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ গ্রামের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এখন সহজেই বাঁওড় পার হতে পারছে। গ্রামবাসীদের মনের ধারনা এ’সেতু হওয়ার ফলে দ্রুত উন্নয়ন ঘটতে শুরু হয়েছে।

ঝাঁপা গ্রামে গড়ে উঠা অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানঃ
১. অনেকগুলো মসজিদ (মুসলমানদের একমাত্র প্রার্থনা কেন্দ্র)।
২. দুইটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
৩. একটি বালিকা বিদ্যালয়।
৪. একটি আলিয়া মাদ্রাসা (বাস্ততলা নাম করণ)।
৫. একটি বালিকা দাখিল মাদ্রাসা।
৬. চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
৭. একটি কিন্ডার গার্ডেন (কেজি স্কুল)।
৮. একটি পিকনিক কর্নার (বর্তমানে প্রস্তাবিত পর্যটক কেন্দ্রের আওতা)।
৯. দুইটি নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ড্রামের ভাসমান সেতু।
১০. দুইটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা।
১১. শরিফিয়া দরবার শরিফ।
১২. একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।
১৩. একটি আশ্রায়ন প্রকল্প (সরকারি গুচ্ছ গ্রাম)।
১৪. একটি আই,সি,সি,পুলিশ ফাড়ি।
১৫. অনেকগুলো পুজামন্ডপ (হিন্দুদের উপাসানালয়)।
এছাড়াও আরো গড়ে উঠেছে আকর্শণীয় বিনোদনের অনেক যায়গা।

তথ্য সংগ্রহঃ

১. ঝাঁপা গ্রামের প্রাক্তন সহকারী মৌলভী মৃত আজহারুল ইসলাম (আমার পিতা) এর লেখা উপন্যাস থেকে পাওয়া।
২. বাংলার ইতিহাস কে আলী।
৩. ইসলামের ইতিহাস হাসান আলী।
৪. ভারতের ইতিহাস অতুল চন্দ্র রায় (১ম খন্ড)।
৫. ঝাঁপা এলাকার বিভিন্ন সুধী ব্যাক্তিগন।