ক্ষমা

September 18, 2024

ক্ষমা

(পারিবারিক উপন্যাস)
মৌলভী মুহাঃ আজহারুল ইসলাম।
অর্পণঃ
বইটি আমার স্নেহের জামাতাঃ মোঃ হাফিজুর রহমান, মেয়ে মোছাঃ হাছিনা পারভীন, পুত্রঃ মোঃ আশরাফুজ্জামান এবং মুহাঃ মোশাররফ হোসেনের নামে অর্পণ করিলাম।
সার্বিক সহযোগিতাঃ
মুহাঃ মোশাররফ হোসেন।
নিউজ বিডি জার্নালিস্ট ২৪, রাজগঞ্জ বাজার, মনিরামপুর, যশোর।
যোগাযোগঃ +৮৮০১৭৪০-৯৪৮৯৬০
গ্রন্থকারের আত্মকাহিনী এবং পরিচিতিঃ
মুহাঃ আজহারুল ইসলাম ১৯৩৭ সালে যশোর জেলার অন্তর্গত  মনিরামপুর থানার অধীন ঝাঁপা গ্রামে কোনো এক আদর্শ মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাহার পিতা একজন ধার্মিক লোক।
আজহারুল কৈশোর কাল থেকে নামাজ কালাম, পাক-পবিত্র থাকতেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে তাকে অদুরে নেঙ্গুড়াহাট মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। ১৯৫১ সালে – দাখিল পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। পূনরায় আলিমে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন।  আজহারুল একজন নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী ছাঁত্র। সবাই তাকে ভাল বাসত স্নেহ চক্ষে দেখত, এতে ক্লাসে লম্পট হিংসুটে ছাত্ররা- জ্বলে-পুড়ে মরতো। নানাভাবে তাকে নির্য্যাতন করতো।
সকল বিপদ, বাধাসমুহের মধ্য দিয়ে ১৯৫৫ সালে তিনি আলিম পরীক্ষায় পাশ করেন। তথায় উচ্চ শিক্ষার কোন ব্যাবস্থা না থাকায় অন্যাত্রে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে লাউড়ি মাদ্রাসা থেকে ফাযিল পাশ করেন। সে যুগে আলেম লোক সমাজে খুবই কম ছিল। তখন ষোলখাদা মাধ্যমিক স্কুলে মৌলভীর পদ শুন্য থাকায় আজহারুল ইসলামকে তলব করিলে তিনি বিনা দ্বিধায় ষোলখাদা মাধ্যমিক স্কুলে মৌলভী শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। তখন থেকে শুরু হলো তার কর্মজীবন। নিশ্চিন্তে তিনি নিজের পান্ডলিপি  লিখে তার নামকরণ করেন “ক্ষমা”। এর পর যৌতক, বাশর ঘরের দুয়ারে, এবং কলাবনের কালাচাঁদ, কালো মেয়ে বই গুলি লিখে হাত ধুয়ে বসলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিনত হচ্ছে। এহেন অবস্থায় তাকে ডাক পড়লো নিজ গ্রামে নব প্রতিষ্ঠিত ঝাঁপা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার জন্য। বাধ্য হয়ে তিনি ১৯৭৫ সালে ঝাঁপা মাদ্রাসায় সিনিয়র শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন।  আজহারুল আরবী সাইডের শিক্ষক ছিলেন। চাকুরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ১৯৯৭ সালে তিনি সুসম্মানে অবসর গ্রহন করেন।
অবসর থাকাকালীন সময়ে তিনি পূর্বের মত লেখা লেখীর কাজে লিপ্ত হলেন। কালো মেয়ে, অবহেলিত কন্যা, পুতুল রানীর কুদ্দুস, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ইত্যাদি বইগুলি লিখেছেন, তবে “ক্ষমা” বইটি গ্রন্থকারের একান্ত আত্মকাহিনী।
  প্রথম পরিচ্ছেদঃ
     ব্রিটিশ শ্বাসনের অবশানের পর, পাক শ্বাসনের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় ব্যাপকভাবে শিক্ষার প্রচলন ছিলোনা। যদিও কিছু সংখ্যাক শিক্ষানুরাগী লোক দেখা যেত।  তার কিছু অংশ সাধারণ শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত। ধর্মীয় শক্ষানুরাগী লোক খুবই কম। সে আসলে মক্তব মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষার বিরাট ভূমিকা ছিল না।
সে আমলে যশোর জেলায় কথক গুলি মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। তাহা পরিচালিত হত জনগণের অনুদান দ্বারা। তন্মধ্যে নেঙ্গুড়াহাট মাদ্রাসাটি উল্লেখযোগ্য। তা কাঁচা ইটের তৈরী করকেট টিনের ছাউনী।
    মাদ্রাসাটি দক্ষিন দুয়ারী, সম্মুখে উম্মুক্ত খেলার মাঠ ও  একটি ঈদেগাই ময়দান। তথায় ঘুসলমানরা বছরে দু বার ঈদের নামাজ সমাপণ করে।
উত্তরে বিশ্বনাথ সেনের সুরচিত বিরাট আম্র কুঞ্জু। তাতে নির্ম্মিত দোতলা বিশিষ্ট একটি অট্রলিকা।
    পূর্বদিকে অবস্থিত একাটি নাতি ক্ষুদ্র বাজার। তাতে দোকানদার অপেক্ষা খরিদ্দার বেশি, প্রচুর পরিমান আমদানি রপ্তানি হয় তাই। পশ্চিম দিকে বিরাজমান পানি ডহরা নামক জমাটি বিরাট বিল। বর্ষাকালে তার কানায় কানায় জল থাকে। মাঝে মাঝে দু-চারটি টোকা শেওলা ও ফাঁকা ফাঁকা কচুরি পানা ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হয়না। হয় মৌসুমী বায়ু প্রবাহে ছোট ছোট ঢেউ এর দোলায় এমন এক মনোহর রুপ ধারন করে, তাতে দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে যায়। তখনকার যুগে ধর্মপ্রান লোকের সংখ্যা ছিল নুন্যতম। যে নিমিত্তে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী সংখ্যাও নগণ্য ছিল। তন্মধ্যে আজিরুদ্দীনআহম্মেদ ছিল আদর্শ ছাত্র। সে যেমন ভদ্র, বিনয়ী তদ্রুপ সান্ত শিষ্ট স্বভাবের লোক, সমাজে অমায়িক ব্যাবহার গুনে সে জনপ্রিয়তার অধিকারী হয়।
    আজিরুদ্দীন কোন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিঃস্ব-দরিদ্র সন্তান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় তার যেমন মুনাস ছিল, তদ্রুপ মাদ্রাসায় পাঠকালেও তদ্রুপ শিক্ষা-দীক্ষায়, আচার ব্যবহারে সে ভাল ছাত্র। বাৎসরিক খেলাধুলার অনুষ্ঠানে সে প্রতি বারই সৎ চরিত্রের দরুন সে একটা পুরুস্কার পেয়ে আসছে।
    সভাবতঃ সে শান্ত শিটট ও ভদ্র ছাত্র। সাতচড়ে কারো সাথে কথা বলেনা সর্বদা হাস্যমুখি। বড় দূর্দিনের সময়, অভাব অনাটনে কেহই লজিং এ থাকতে পারলোনা। ক্ষুধার জালার একে একে সকলেই নিজ বাড়ীতে কাল কাটাতো। তখনও আজিরের জন্য সকল দরোজা খোলা। পার্শ্ববর্তী এলাকার লোক দাওয়াত করে শুখের খানা বের করে খাওয়াতো। লজিং সমস্যা তার আদৌ ছিল না।
    সৎ করিত্ব মানুষের ভূষন। নবী রাসুল তথা পীর-আওলিয়া গাওস কুতুবদের ভুষন। শ্রেষ্টেত্বের যেমন কোন সীল মোহর নেই, তদ্রূপ সাধারন লোকের সদগুনের কোন ডকুমেন্ট নেই। আচারনে ফুটে ওঠে তার সহানুভবতার লক্ষন। সম্মান কোথাও কিনতে পাওয়া যায়না, নিজেই অর্জুন করে নিতে হয়। আজিরের জীবনাদর্শের প্রতিটি স্পৃহায় সততা, সাধুতার রুপ গন্ধ সন্নিবেষিত। তাই জাতী ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই তাকে ভালো বাসতো। দুর্য্যোগময় শীতের কুয়াশা ঢাকা নোংরা অন্ধকার ভেদ করে  পূবের আকাশে দৃষ্ট হয়। সুবেহ সাদেকের প্রথম আলোর আভাষ, কত প্রশান্ত তপস্যর পর কি আশ্চর্য আশা ভরসা নিয়ে আসে সেই  আলো। এ ধরা শ্রোষ্টার লীলাভূমি কতনা আশ্চর্য সৃষ্টি কৌশল তৈরী। যদিও মানুষ আসা যাওয়ার বেড়াজালে আবদ্ধ।
   আজিরের সু-আচরণে সবাই মুগ্ধ। সীমারের মত নিকৃষ্ট পাষাণ্ড লোক ও তার কাছে ধন্না দিত। জীবনেও যারা অথিতি আপ্যায়ন করতোনা, স্কুল, মাদ্রাসার ছাত্র লজিং রাখার কথা বললে কর্নপাত করতোনা তারাও শেষে প্রস্তাব দিল আজিরকে লজিং রাখার জন্য।যার জন্য সকল দরোজা খোলা। অন্যের প্ররোচনায় লজিং পালটানো আদৌ তার শোভা পায়না। মনে মনে নিল, এখন থেকে যে লজিং রাখার কথা বলবে তাকে ঝাড়া জোয়াব দেওয়া হবে। তাকে সোজা বলবো মাদ্রাসা প্রধানের আশ্রায় নাও। বার বার লজিং পালটানো কু-স্বভাব। হুঁহাতে লোক সমাজে নিন্দনীয়। কারোর কারোর মুখ কালো দেখতে হয়। তবে মাদ্রাসা প্রধান কর্তৃক লজিং পালটালে ব্যক্তিগত ভাবে দোষ ত্রুটির সম্মুখীন হতে হয়না। কারোর দৃষ্টিকটু বিষয় দিক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এবং লজিং পাল্টানোর চাপের মুখে নিজেকে সামলিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
এর পর থেকে লজিং এর প্রস্তাব আনীত হলেই মাদ্রাসা প্রধানের দোহাই দিয়ে নিজেই সব এঁড়াতে যেয়ে দোষ-যুক্তভাবে এক লজিং এ কালযাপন করতে থাকে।
                দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ
   কপোতাক্ষ নদী এঁকে বেঁকে বিভিন্ন জেলা উপজেলা, গ্রামগঞ্জ তথা পাহাড় পর্বত ভেদ করে সুদুর বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এর কোন  এক বাঁকের পূর্ব প্রান্তে অবিকাল ডিম্বাকারে সু-বৃহৎ একটি দ্বীপ, তার তিন পার্শ্ব বেষ্ঠিত জলাকার, তাতে পানির অন্ত নেই। ইংরেজ শাসনের প্রাক্কালে দ্বীপটি ছিল জনমানব শুন্য। বিস্তীর্ণ অসমতল ভূমি। মাঝে মাঝে ঝোপ-ঝাপ ছোট ছোট বন বনানী। তাতে বিভিন্ন জীবজন্তু বসবাস করত। নানা রঙের পাখিরা গুঞ্জরন করত।
তৎকালে পূর্ব বাংলায় বিরাট এক জল প্লাবন হয়, তাতে অসংখ্য নরনারী অকালে মৃত্যু মৃত্যুবরন করে। কেহবা দেওয়ালে চাপা পড়ে আবার কেহবা খাদ্যাভাবে কেহবা সন্তান সন্তাত্ত হারা চিন্তায় ব্যকুল। এ দৃশ্য মর্মান্তিক, কতনা নিদারুন ও করুন, এইটা জল প্লাবন “জোড়া বন্যা” নামে অবিহিত। ততৎকালীন বন্যার জলে ভাস্যমান অবস্থায় অনেকেই এদিক সেদিক গিয়ে কূল কিনারা পেল। কিছু পরিবার খড় কুটো, পল বিচালি গাদার উপর বসে নিরুদ্দেশে ভাস্যমান। খাল বিল পদী লালা সর্বত্র একাকার, ঘর বাড়ী সবই বিধ্বস্ত। সামান্য কিছু গাছ বৃক্ষ ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টি গোচর হয়না। দ্বীপটি এত সুউচ্চ তার অনেক স্থান শুষ্ক, যেহেতু চতুদিক ইতে বহু লোক অত্র দ্বীপে আগত। ফল মূল খেয়ে তারা জীবন যাবন করে।
   কিছুদিন পর যখন ভাটির টানে চতুর্দিক হতে পানি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষিত হয়ে দ্বীপটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলো তখন কেহই স্থির থাকতে পারলোনা। বাড়ি ঘরের মায়া মোহে উন্নিত একে একে সকলে অস্থায়ী স্থান ত্যাগ করলো। ভূমিহীন অসহায় নি:স্ব গরীব লোক স্ব-গৃহে ফিরে গেলো না। তাদের সকলের একই কথা অর্থ নেই, বিত্ত নেই, কপর্দক শুন্য, এমন কোন সম্বল নেই, যাহা বিক্রি করে বাসা বাড়ি মেরামত করা ও জীবন যাত্রা নির্বাহ করা যায়। সেহেতু তারা একমতে একদলে স্বদ্বীপে খাস স্বতিয়ানের পতিত জমি খুড়ে ফসল উৎপাদন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো।
কিছুদিন পর জেলে মালোদের চোখ পড়লো দ্বীপটির উপর, চমকে ওঠে ওখানেতো জনমানবের বসত বাড়ী নেই, ছোট ছোট কুড়ে বেধে কারা বাস করে? যাযাবর বেদুইন কিংবা নোয়াখালি, ত্রিপুরার উদ্বাস্থ না কি? তা পরিদর্শন করার উৎসাহ উদ্দীপনায় যখন জলাশয় বাড়ি দিয়েছিল, বোধ করি তখন পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা স্থির থাকতে পারলো না। বাঙালি হুজুরকে মাতাল কোন আশ্চর্য ঘটনা শুনে কেহ নিশ্চুপ থাকেনা। তার তথ্য সংগ্রহ না করে ঘর লাগে না। কৌতুহল দৃষ্টিতে পর অপারের ছোট ছোট ঘুরে দেখে অনেকের ইচ্ছা জাগলো স্বচক্ষে দেখার। সেই নিমিত্তি ডুঙ্গা ডিঙ্গি কিম্বা বেলাই টিপে গিয়ে উঠলো। যে যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না। ইহাতে সকলের দেখার উৎকণ্ঠা ক্রমান্বয়ে প্রবল হয়ে উঠলো। কিছু সংখ্যা যুবক পানিতে ঝাপ দিয়ে মনের খায়েশ মেটাতে চাইলো। হলে সাতার দিয়েই তারা কুলে উঠলো এবং পরস্পর পড়ার মধ্যে টিনা পরিচয় ঘটে গেল। সুতরাং ঝাঁপ দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে নদী পাড়ি দিয়ে উদ্বাস্তদের খোঁজখবর লওয়ার প্রেক্ষিতে একটি ঝাঁপা নামে অবিহিত।
   বহুদিন পূর্বের কথা হাজের আলী মোল্লা নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত লোক এখানে বাস করতেন।  অর্থ বিত্ত জায়গা জমি তার খুবই কম ছিল।  অধিক কন্ঠ কাজকর্ম মোল্লাগিরি দারাই গরিব খানা ভাবে জীবনজাপন করতেন। তারপর  দুই পুত্র এক কন্যা জ্যেষ্ঠ পুত্র আজির উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা পরিসমাপ্তি করার পর সাংসারিক কাজে আত্মনিয়োগ করে। পাড়া-প্রতিবেশীরা বিরাগভপোষণ করে। মেধাবী ছাত্র অর্থভাবে শিক্ষার অগ্র পথে যেতে পারলো না? এটা তো ভালো কাজ নয়। শেষে সর্বসম্মতি ক্রমে আগের কে পোলাহাট মাদ্রাসায় ভর্তি করে যাওয়া হলো। যার পরিচয় পাঠকবর্গ পূর্বেই অবগত হয়েছেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ
    বেলু মোড়ল একজন মধ্যবিত্ত লোক, জায়গা জমি তার অগাধ। তদুপরি প্রতি বছর যা পাই ছোট সংসারে সারা বছরের ভরণ পোষণ মিটে যায়। উপরন্ত ক্ষেত খামারে ও বর্গা ভাগের দ্রব্য বিক্রি করার পর সঞ্চায়ী ব্যাংকে জমা হয়। তার মাত্র এক পুত্র আর এক কন্যা। একমাত্র পুত্র মাহমুদকে তিনি নিশ্চিন্ত নয়। মাতৃহারা আখিরনের চিনতাই ঘুম নেই। তৎকালে মেয়ের বাজার সস্তা পাত্র দুঃষ্প্রাপ্য বস্তু। যদিও কদাচিৎ দুই একটি পাত্র মেলে, তাও আবার বিড়ালের কাটা বাছার মত। মাতৃহারা কন্যা কেউ পুষতে চায় না। ই হাতে তিনি কন্যাদায়গ্রস্থ, পার্শ্ববর্তী পার্শ্ববর্তী এলাকার অনেকেই স্কুল ছাত্র লজিং রেখে কন্যাদায় সমস্যা মেটাচ্ছে। তিনি হতাশার মাঝে যেন আশার আলো স্বরূপ পথ খুঁজে পেলেন।
আখিরুন এবার বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। এ যাবত সে প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়ে উত্তীর্ন হয়েছে। এবার তার সমস্যা অংকে তাতে পাশের আসা কম। সেহেতু সে ভ্রাতার সাথে প্রাইভেট শিক্ষক নিযুক্ত করার কথা উল্লেখ না করে পারলো না।  মাহমুদ যখন জানতে পারলো আখিরনের জন্য একজন  প্রাইভেট শিক্ষকের অত্যাবশ্যক। অতএব নিজের নিজের বৃদ্ধ পিতাকে উপায়ান্ত না দেখে মাদ্রাসা প্রধানের নিকট পাঠায়ে অংক,  ইংরেজি, শাস্ত্রে পারদর্শী একজন ছাত্র আনায়ন করে লজিং রুপে স্থান দিল নাম তার আজির উদ্দিন। আকরণ তথ্য ও সকাল সন্ধ্যায় দীর্ঘ শিক্ষকের নিকট অংক,  ইংরাজি পড়া করে। তাতে ক্রমান্বয়ে তার পড়ার উন্নতি সাধিত হয়। যেবার সে সাথে উত্তীর্ণ হল সে বর্ষে গৃহশিক্ষক আলিমে সেন্টার ক্লাসে উত্তীর্ণ। তখন থেকে আচরণের মনে ঢুকে, বইয়ের পাতা শুধু গুণে যাচ্ছে, চক্ষু তার মাস্টারের মুখ পানে। অপলক দৃষ্টিতে সে তার রূপ, সৌন্দর্য দিয়েই আত্মতৃপ্তি লাভ করে। মাস্টার নিরবে তার নিজের পাঠ মুখস্থ করেন। ছাত্রী যে তারই মুখ পানে একাদৃষ্টিতে চেয়ে মিস মিস করে হেসে যাচ্ছে। কি খবর তিনি আদৌ রাখেন না। একদা রাত্রে আখিরন মাষ্টারের কক্ষে পাঠাভ্যাস করছে, বাদ্য বাধক বিষয়গুলো সুষ্ঠভাবে পড়ায়ে দিয়ে তিনি নিজ পক্ষে মনোনিবেশ করছেন। তৎকালে গৃহশিক্ষকের অজ্ঞাতসারে একাদৃষ্টিতে চেয়ে সে মাস্টারের রূপ সৌন্দর্য ভোগ করছে।  সে তার সুরভী ঘ্রাণে তন্ময়। মাস্টার মহাশয় গাড় ফেরায়েই দেখতে পেল ছাত্রীর চাহনি। চঅক্ষু  তার সড়ক গাছ অন্যভাবে বুঝলেন। ওর অন্তর আত্মা মানব দেহে নেই। তার ভাবভঙ্গি দর্শন করলে গড়া যৌবন বয়সের কোন লক্ষ্মণ না ভেঙ্গে পারে না। রমণী স্মল প্রবন, তারা নমনীয়, অল্প আঘাতে মুসড়ে পড়ে, তেমনি অল্প দিনেই তারা সবকিছু  ভুলে যায়। অতি সহজেই তারা বাঁচাতে পারে। তেমনি সহজে তারা প্রানে মারতেও পারে । বিপদগামীকে যেমন জাদুর স্পর্শে ধর্ম পথে রাতে পারে। আউলিয়া পীর ফকির কেও তেমনি পথভ্রষ্ট করতে পারে। যেহেতু এই নিরালা নির্জন কক্ষে  কোন বয়স্ক রমণীর এই রূপ মহাচ্ছন্ন ভাবভঙ্গি দর্ষণ করে, রক্তমাংসের মানুষতো দূরের কথা খুনির মন ও না টলে পারে না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করার করার পর, ছাত্রীকে লক্ষ্য করে বলেন আখিরণ তোমার ভাব ভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে তুমি গোল্লাই গেছো। তোমার ক্ষতিছন্ন  বাকি নেই। তাই প্রত্যহ ঘাটে পথে পায়তারা দিয়ে বই পড়ার বাহানায় রোজ রাত্রি তলে তলে বুঝি এরুপে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলি গুনে সময় কাটাও? একটু থেমে বলল ইহা ইয়ার্কি ফাজলিমির জায়গা না। যদি তুমি বড় না হতে তবে উচিত শিক্ষা পেতে। রক্ষে যে তুমি বড় হয়েছো, শাস্তিতো দূরের কথা তাকানোও দোষের। লেখাপড়া যা শিখেছো? বাপ ভাইয়ের উচিত তোমার বিয়ে দেওয়া। টিপি টিপি বলে বিরক্তি করলো না। এক পলকে পক্ষের বাইরে গিয়েই রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলেন। আখিরণ মাস্টারের কাছে হাতে কলমে ধরা পড়াই  একেতো লজ্জিত, তদুপুরী তার তিরস্কার পেয়েই সর্বস্বান্ত। মনের ভেতর ওর সকল চিন্তা তারই তিরস্কারে করে মুছে গেল। শান্ত শিষ্টভাবে পাঠে মনোনিবেশ না করে পারল না। গৃহবধূ মআষ্টারের খাবার গুছিয়ে ননদের অপেক্ষায় ছিল, টাকাটা কি করেও তার নাগাল পেলোনা, তখন নিরুপায় পর্দা উম্মোচন করতে বাধ্য হল। পড়ার ঘরের দুয়ারে গেলেই পা তোলার সাহস পাচ্ছে না। ননদকে ডেকে দায়িত্ব এড়াবে তার পাঠ্যপুস্তাকে আত্মনিয়োগ দেখে টাকার ইচ্ছা হলো না। তার অগোচরে খাবারটি টেবিলের উপর রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। এখবর আখিরন রাখেনা। যখন বইপুস্তক সহ বেরিয়ে পড়বে তখন চোখ পড়লো খাবার টেবিলের উপরে। থমকে গেল আখিরন মনে মনে ভাবল এখাবারতো দিন আমি বয়ে আনি ভায়াতো ভুলেও এ ঘর পা বাড়ায় না। তবে কি ভাবি দিবে? সেতো কুলের বধু আদ্যবধি সে মাস্টারের ছায়াও ডিঙ্গায় না। এখানে আসার সাহসতো তার নাই, কখন কে রেখে গেল। এতোটুকু চিন্তায় অভিভুত হয়ে পড়ল। যারা এই মনে মনে সেই কল্পনার জাল বুনতে লাগল। এবং পক্ষের বাইরে আসলেই থাকনা মামনি মাস্টারের সহিত সাক্ষাত ঘটল। তাকে দেখেই আখিরণের কিছু জিজ্ঞাসার ক্ষমতা থাকল না। লজ্জাবনত মস্তকে সে পাশ কেটে ফেলে গেল।
     চতুর্থ আন্তর পরিচ্ছেদঃ
   সেবারগো ফাগুনের দুইইদিন পর। আজির যথা সময়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে এসেই দেখতে-পেল, সম্মুখস্থ বাড়ীতে বহু লোকের সমাগম। কিজন্য এত লোকের শোর-গে গোল- তা, জানার উৎসাহ তার এমন ডাবে প্রবল হলো যে, টেবিলে খাবার রেডি। খাওয়া তো দূরের কথা, ফিরেও চাইল না। তাৎ ঘড়ি ঘটনা স্থলে গিয়ে হুজির। তখন তার মুখ-খানা যেন সুক্ষ ভাব। দেখলো অত্র বাড়ীর এক নব বঁধু খুটিতে বাধা। লোক, তাই, ধরে না। তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেল নববধুর ঘরে জীনের আছর। নিরাপত্তার জন্য নব বঁধুর বেধে রাখা। বলার অবকাশ রাখেনা। আজির পূর্ব থেকেই আধটু ভয় ভীতে র -একটু তদবির করত। ফুক কাক দিত।  এইক্ষণে তার উপস্থিত যেন আশীর্ব্বাদ স্বরুপ দেখাচ্ছিল। নিরাশায় খানে আশার আলো, অগতির গতি, অভরসার ভুরসার স্থল হল।
   উপস্থিত জনমণ্ডলী- তাকে জড়িয়ে ধরল, “মাষ্টার” আমরা দিশাহারা, পথ-খুজে পাচ্ছি নে। গৃহস্বামী তো, হাক্কা বাক্কা একেবারেই হত জ্ঞান। একেত- গরীব লোক, না আছে অর্থ বিও, না আছে তার বুদ্ধি জান। এযেন হাঁফাতে ঘরে, খোড়া বয়াধি। আশে পাশে খুজলেও ভুতুড়ে কবিরাজ মেলে না। এইখানে আমাদের জোর দাবি। রোগীটাকে একটু চিকিৎখা করে দেখুন।”
    জীন ভূতের তদবীর জানা থাকলেও
তা তার আমল ছিল না। সেখানে থাকতে হয়। বাড়ীর বাগান ভাঙ্গা অনুচিৎ- ভেবে অনুরোধে ঢেকি গিলার মত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে জীন ভূতের তদবীর করতে হল। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত। ফুক ফাকের তদবীর হাতে বাধতেই রোগিনী ঘাড় ফুলিয়ে গর্জে উঠলো। দাঁত খিচিয়ে সে ছাঁয়া দেখালো তাতে তার আক্কেল গুড়ুম। অন্তরাত্মা কেপে উঠলো। এধরায় সব রাখার জায়গা আছে? কিন্তু ভয় রাখার জায়গা কোথাও নেই। খুটি জড়িয়ে না ধরলে সে সামলাতে পারতনা।
   রোগিনী কহু চেষ্টা করেও যখন দেহের বাঁধন খুলতে পারল না, তখন বোধ করি হাঁকিয়ে উঠলো। তদবীর কারীর প্রতি লক্ষ্য করে সে গুরু গম্ভীরভস্বরে বললো “ওহে অর্বাচিন মাষ্টার। বিদ্যে জাহির করতে জায়গা পাওনি! সামান্য তিন পাতার তদবীর করা শিখে জীন ভূতকেও আয়ত্বাধিনে আনার দুরাশা। এ বর্দাস করা যায় না। বাউন হয়ে আকাশের চাঁদ ধরার স্বপ্ন সুদুর পরাহাত। এতবড় স্পর্দা তোর। নিজের দেহ বন্ধের মন্ত্র তন্ত্র না শিখে যে এসব রোগীর গায়ে হাত দেওয়া, তার ফলাফল কতদুর দাড়ায় তা কি জানিস্? তার মাথা ঘুড়িয়ে ঘাড় ধরে যুগেন পোতা হত।
  এরপরআঙ্গুল নাচায়ে বললো, “রক্ষে, তোর জোর বরাত, আল্লাহর ফেরেস্তারা তোর গমন পথে নুরের ডানা বিছিয়ে দেয়। বিনা বাক্যে রাগ সংবরণ না করে পারলাম না। বলে দিলাম জীবনেও একাজ করিস নে কোনদিন এমন রোগীর গায়ে হাত দিসনে। দিলে সেদিন তোর জীবনের ষোল আনাই মাটি। একটু থেমে বললো, আমি গণ্ডির-ধারেও যাবনা। এমনিই চলে যা -চলছে বাক্য অসমাপ্ত থাকতেই একখানা থাখের শাখা ভূপাতিত করে দৌড়। কিছু কিছুদুর অগ্রসর না হতেই রোগিনী মুর্চ্ছা গেল। তৈল পানি গায়ে দিলেই সংগা ফিরে পেল। আজির মাষ্টার দশের সম্মুখে কান মর্দ্দন করতে-করতে-বললো, জীন ভূতের-তদবীর-কদাচ কর বলার করবনা, করবনা, করবনা।
       পঞ্চম পরিচেছদঃ
    একদা পূর্ব্ব বর্ণিত-ঔষধ বিক্রেতা। দোকানে না বসতেই আাজিরের প্রতি জীনের হুসিয়ারী। আল্লাহর ফেরেস্তারা তার গমন পথে পার বিছিয়ে দেয়। এতটুক সম্মানের খাতিরে জীন গন্ডির মধ্যে গেল না, এমনি চলে গেছে। এ কথা তিনি আদৌ বিশ্বাস করেন নাই। হাস্যে উড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন#  ইহা কক্ষনও সত্য নহে ভিত্তিহীন। পরক্ষনে অলিতে গলিতে জীনের উক্তি কানা কানির বিচার শুনে তার চিও আকর্ষন করলো। তথ্য সংগ্রহ করে জানা গেল, আজির-সম্পর্কে জীনের উক্তি মিথ্যা নহে, ঘটনা বাস্তব সত্য। সেদিন থেকে আজিরের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্শন করলো। দোকান খুলেই আজিরকে না খুঁজে তিনি দোকানে বসতেন না। সন্ধ্যা না হ’তেই নাস্তা করার-খরচ না দিয়ে শুন্য হাতে বাসায় পাঠাতেন না। আচারন ভাল হলে, কিংবা মুখের ভাষা মিষ্ট হলে; কোন কিছুর অভাব হয়না, সততার বলে পরকে আপন করা যায়। বাড়ী থেকে পড়ার খরচ না পাইলেও আজির রিক্ত হস্ত-নহে। পাকেট পরি হাট বাজারে গেলেই তার
পকেট ভারি। বিনা আয়াশে অযাচিত ভাবে তার পকেটে অর্থ আসে। মাইসুদ আর ঔষধ বিক্রেতা থেকে যে অর্থ বরাদ্দ হয়, তা তার পক্ষেই যথেষ্ঠ। পরের তেলে পোদ্দারী। পরের টাকাই বাবু গিরি। এতে নিজের  ব্যাক্তিত্ব থাকেনা। এভাবে আজির বিনায়াশে পরম সুখ-সাচ্ছন্ধে শিক্ষা-লাড করে।  কিন্তু ভেবেও দেখে না কাদের অর্থে পড়ছি। মার চেয়ে যে দরদ দেখায় সে ডাইনি বুড়ি। কখন সে ঘাড় মটকিয়ে সুদে আসলে, কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিবে এচিন্তা সে করেনা। হাট বাজা চাইলেও ঢাকা- পায়। পকেট পুরে ফুল্ল মনে সে বাজার থেকে পকেট ভর্তি টাকা আনে। নতুন লজিং এ আগমনের পর থেকেই আজিজের বাসার মালিক যাবতীয় খরচ যোগাচ্ছে। মাঠের চাঁদে নতুন বস্ত্র ভাইয়ের দোহাই দিয়ে ছাত্রি যোগাচ্ছে। এ সুখ কি ছাড়া যায়? দিন দিন পরের কাছে সে যে বিক্রি হতে চলেছে এই অনুভূতি তার নেই। অধিকান্ত সময় সে শিক্ষা সাধনায় কাটায়।
         ষষ্ট পরিচ্ছেদঃ
    সেবার-শরতের অবকাশে আজির নিজ বাড়ি গমন করল। মনের হরসে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। এই সময় বাসার মালিক আকস্মিক ভাবে মারা গেলেন। মৃত্যু শোকে সারা রাত কান্নার রোল। সকাল আটটায় সেই মড়কান্নার সুর ভেসে উঠে আকাশ বাতাসে। পিতৃ নিয়োগের মর্মব্যাথা প্রশমিত না করতে পেরে আখিরণ বুক ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
   গৃহ শিক্ষক্ষকের আগমনের পর মৃত্যুর সেই সমাধি করা হল। কবর স্থানে কেহই রইলোনা। একে একে সকলেই নিজ নিজ বাড়ি অভিমুখে গমন করলো। কিন্তু কেবল মাত্র গৃহ শিক্ষ আসেনি যে সোজা ভবদহর নদীর কুলে গিয়ে দাড়ালো। স্থান কাল পরে, নদীর সচ্ছ শাললে অবগাহন করার পর, তিলার্ধ বিলম্ব করল না, তৎঘড়ি বাসার দিকে ফিরে আসলো। যেই মাত্র বাসায় পদার্পন করল কনে ঝংকার দিল অন্দর মহলে হায় হায় রব শুনেই বিস্মিত! তাড়া হুড়ো করে কাপড় পাল্টালো, এবং ক্ষিপ্ত গতিতে অন্দর মহরে প্রবেশ করেই আখিঁয়নের বিভৎস দৃশ্য দৃর্শন করে সে স্থির থাকতে পারল না। স্বহস্তে পরিচর্যা করতে আরম্ভ করলো।
   কিন্তু তার বিবেকে ধাক্কা দিল। মনে মনে ভাবল, এভাবে লোকের পিড় ঠেলে ঘটনা স্থলে যাওয়া মুস্কিল। দুর থেকে ডাকি উকি মেরে দেখল, সে পিতৃবিযোগে শোকাহত। লেবু তলায় শীড়ে করা ঘাটে আছাড় পিছোড় খেয়ে, দাঁতে দাঁতে খিল লেগে অসাড়ভাবে পড়ে রয়েছে। কেহই তাহার দাত মুখ ফাক করতে পারছে না। কারোর ভরসা নেই, সবার একই কথা, এর জন্য ও হয়তো কবর খুড়তে হবে,  যেহেতু আকস্মিক মৃত্যু কান্নায় তারা হাই হুল্লাহ, সকলে উচ্চস্বরে কাঁদছে ও শোকে কাতুর।
    এ বিস্ময়কর নিদারুন দৃশ্য দেখে মাষ্টারের ধৈর্যচিত ঘটল, হিতা হিত জ্ঞান থাকলোনা। বিনা হুশিয়ারে স্বহস্তে ভিড় ঠেলে লেবু তলায় গেলো। সাধ্যমত ফুক ফাক দিলে রোগী হাত-পা নাড়া চাড়া করতে থাকে। তখন সভার মনে আশার সঞ্চার হলো। কিছুক্ষন পর সে জ্ঞান ফিরে পেল। চক্ষু মেলে চেয়ে দেখল, সম্মুখে যেন কোন এক সু-পুরুষ বসা। অশ্রুবর্ষনে চোখে বাধা দৃষ্টি, স্পষ্টভাবে দেখতে খাচেছ না, চেনা চেনা বোধ হচ্ছে। সন্দেহ নাশ কার্থে গৃহ বঁধুকে লক্ষ করে, ” ভাবি! ইনি কি তিনি?” প্রতিউত্তরে তোর অনুমান সত্য লক্ষি সোনা। ইনিই ভিড় ঠেলে না আসলে তোরও মুখ দেখতে পার তাম না। রক্ষে তোর আয়ুকাল ফুরায়নি বলেই ইনার আগমন। রোগীর মুখ নিঃস্কৃত শ্রুতি কতু কথাটা শুনে মাষ্টারের মনেও ধাক্কা লাগে। ভ্রুক্ষেপ করল না, রোগের ঝালে আবোল তাবোল কয়, ভুল বকে। এ নিয়ে কেও মাথা ঘামাবেনা। এই ভেবেই তার পিছুটান ভাব দুরিভুত হলো। সহানুভুতিকল্পে ছাত্রীর হাত ধৃত করে, বড় ঘরের দাওয়ায় রেখে তিনি ধীরে ধীরে বি-ক্ষোপে চোখের আড়ালে মিলে গেল।
         সপ্তম-পরিচ্ছেদঃ
    এক কালে এদেশে মেয়ের বাজার গরম ছিল, মেয়ের চাহিদা মোতাবেক, কন্যা কর্তার মানমর্যাদা “ঠাকুরের” সমতুল্য। কালো ধলো মানা মানি নেই কন্যা যারই আছে। তার উঠানে ধুলা কনাও থাকত না। শেষে পন না – নিয়ে কেহ  কন্যা পাত্রস্থ করত না। তৎকালে কন্যা কর্তার মনে কতনা গর্ব। প্রগতিশীল শিক্ষার যুগে তার বিপরীত। যৌতুক দিলেও দিলেও পাত্র মেলে না। যদিও দু’ একটা চয়েজ মোতাবেক জোটে তাদের আবার উপরটান। আশার পিছনে তারা শিক্ষার অগ্রপথে ক্রমে ধাপিত। বিয়ের কথা শুনলে তারা পৃষ্টদেশ দেখায়। পরিশেষে স্কুল মাদ্রাসার ছাত্র লজিং রেখে গাভুলা করে অনেকেই কার্যসিদ্ধ করতো। ছেলে-মেয়ে বেসামাল ভাবে দেখা সাক্ষাতে ভাব প্রবন হলে, কন্যাদায় সমাস্যা সমাধানের পথ পেত। সহজেই বিয়ের কলেমা ঢোকায়েই নিষ্ক্রান্ত হত।
    সম্পত্তি ভেলু মোড়ল, কন্যাদায় গ্রস্থ একমাত্র কন্যা আখিরনকে প্রাথমিক শিক্ষা পর, মাধ্যমিক শিক্ষাপ অঙ্গনে পাঠালেন, কেবল-সুপাত্রে দিবার জন্য, বড় ঘরের মেয়ে নিকার আগে অনেকেরই আগ্রহ প্রকাশ করে বটে, মাতৃহারা কন্যা বলে  বিড়ালে কাঁটা বাছার মত পুছতে চায় না। গৃহস্বামী ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আজিরকে বাড়িতে স্থান দেন, এবং কন্যার গৃহশিক্ষক, নিযুক্ত না করে অন্ন গ্রহন করেন নাই।
     আখিরন কচি মেয়ে না। হাই স্কুল সেখা মেয়ে। তদুপরী কিশোরী বয়সে বাসন্তি হাওয়ার হাওয়ার দোলায় তার মনে রঙ ধরে। মনের পটে তার কতনা রঙিন- স্বপ্ন। দৈনন্দিন ভেসে ওঠে তার পুলোচিত মন। যতটা বিয়ের সম্বন্ধ আসল সবারই একই কথা, মেয়ে দৃষ্টিধারী, রূপে গুনে পরিপাটি, কিন্তু মা নাই। এতটুকু দোষে
তারা সবাই পৃষ্ট দেশ দেখায়ে সরে-পড়ে। ইহাতে- আখিরন নিজেকে অসহায়বোধ করে মুষড়ে পড়ে। আশা ভরসা নৈরাশ্যময়। নিরুপায় হয়ে গৃহশিক্ষকের স্মৃতি হৃদয়ে এঁকে দিবার নিশি ভাবা চিন্তা করে। পিতৃবলে মাষ্টারের অগোচরে তার প্রাতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কুক্ষনে আজ সেই পিতৃছায়া তার থেকে
চির তরে সরে পড়লো। প্রিয়তমের যান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় আমার বইল না। সকল সুখ স্বপ্ন কাঁচ পাত্রের মত ভেঙ্গে খান-খান। মনে প্রানে তাকে ভালবাসি। কখনো সে ধরা দেবে না। আব্বা জীবিত থাকলে নিশ্চয় আমার প্রার্থীর মান্নিধ্য লাভ করতে পারতাম। হায় নিয়াতি। ?
    পিতৃছায়া রমণী কুলের বড়  অবলম্বন। অকুলে কুল, অগতির গতি, নিরাশ্রয়ের আশ্রায় কেন্দ্র। ভাগ্য দোষে সে আশাও নির্মূল। যার চরন সেবায় নারী জীবন ধন্য করবো, সে পথেও কাটা। কত আশা ভরসা বুকে পোষন করে; ভালবাসার শ্রদ্ধার মালা গাথলাম, কার গলে পরাবো? আববা জীবিত থাকলে ঐ রাঙা পা বুকে রেখে পরম সুখে ঘুমাতাম, সে পথ ও অন্ধকার, নিয়তির কি কু-পরিগ্রহ। সকল আশা নৈরাশ! তাই বলি বিয়োগ যোগের ক্ষুদ্র নিড়খানি। দুরন্ত বাতাসে উড়িয়ে দিতে তার কি লাভ? এসব প্রশ্ন তার মনের পাতায় একে একে ডুবে ওঠে ভবিষ্যাতের ছবি। সঠিক জবাব খুজে না পাওয়ায় মিতার মৃত্যুদিনে আখিরন লেবু তলায় মুর্চ্ছাঘাতে আচগুঁড়া আছাড় খেয়ে চিৎ পটান। এহেন অশুভ ক্ষনে প্রিয় মুখ দর্শনে চক্ষু পরিতৃপ্তি হল। তদুপরী তার পেলো পরশ হস্ত অঙ্গে স্পর্শ হতেই তার সকল অভরসা কেটে গেল। নিরাশাই যেন আশার আলো রশি ফুটে উঠলো। বড় ঘরের বারান্দার খোলা স্থানে সে চক্ষু মুদ্রিত করে অনাগত সুখ স্বপ্নে বিভোর।
           অষ্টম পরিচ্ছেদঃ
   একদা জৈষ্ঠ মাসে, খাঁটি দুপুরে প্রচন্ড ঘুন্ডু গরমে বাড়ি ঘরে কেহ টিকতে পারে না, অধিকাংশ লোক অতিষ্ঠ হয়ে আম্রকুঞ্জে আশ্রায় নিল। কেউবা সোনা ভানের সুখী পাঠ করে শোনাচ্ছে, আবার কেউবা গল্পের আসর বসাইয়ে আলিফ লায়লার আশ্চর্য গল্প শুনায়ে শ্রোতা মন্ডলীর চিত্ত মুগ্ধ করাচ্ছে। তৎমুহুর্তে ঘর থেকে ঘন্নাক্ত দেহ খানা লয়ে মাহমুদ ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ে। মাদুর বালিশ সহ তাদের সন্নিকটে গিয়ে শয্যা নেই। একাগ্র চিত্তে পুথি পাঠ করা শুনছে। ঝড় বাদলে খা খাওয়া রোদে পোড়া ঘর্ম্মাক্ত দেহে ঝির ঝিরে স্নিগ্ধ হাওয়া প্রবাহিত হওয়াই চোখে মুখে ঘুমের জড়তা আসে। পুথি শুনার আকন্ঠ উৎকণ্ঠার নেশা মিটে গেল। ধীরে ধীরে পার্শ্ব ফিরায়েই চক্ষু মুদ্রিত করে নিদ্রায় বিভোর। ইতি পূর্বে ছোবহান কতিপয়  ছাত্র নিয়ে আজিরের পাঠরুমে এসে হাজির হলো। সালাম বিনিময়ের পর হিন্দু পাড়ায় বিশেষ প্রয়োজনে যাওয়ার জন্য দলভারি করার মানসে আজিরকে জড়িয়ে ধরে, আজির আপত্তি তুল্লেও তাহা ব্যহত হয়। ছোবহান নাছোড় বান্দা। আজিরকে সে না নিয়ে পা বাড়ালো না। ছোবহান উপরের ক্লাসের ছাত্র, তার সম্মানার্থে আজির ওদের দলভুক্ত হয়ে পথে বেরিয়ে পড়লো। যথা সময়ে ছোবহান কতিপয় তরুণ যুবক সহ হিন্দু পাড়ার কোন এক বিধবা রমণীর বাসভবনের সম্মুখস্থ কাছাড়ি গৃহে গিয়ে আসন গ্রহণ করলো। বিধবা কয়েক সন্তানের জননী হলেও তার বয়স খুবই কম। কোন সন্তানাদি হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়। তৎকালে হিন্দু মহলে সে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমনী ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা পালন করে আসছিল।
    ছোবহান পূর্ব থেকে হে বাড়ি যাতায়াত করত, এইখানে সে কতিপয় তরুণ যুবক সহ আগমন করলে, বিধবা কতনা উৎফুল্ল, তাড়াহুড়া করে স্বাগতম জানিয়ে আপ্যায়ন করল। পরক্ষণে মেহমানদের সম্মুখে সে হাস্যমুখে পৃথক পৃথক ভাবে মিষ্টি সামগ্রী ও ছোলা, ফল পাকা আমের থালা রেখে, সম্মুখস্থ স্বয়ং কক্ষের দাওয়াই দিয়ে উপবেশন করলো। মাঝে মাঝে অতিথিদের প্রতি নজর বুলাতে লাগলো।  একে একে সকলেই খাইলো শুধুমাত্র একটি যুবক ছাত্র পাতেও হাত রাখলো না। সে আর কেহ নয় আজির, বারংবার খোশামোদ পড়া সত্বেও যখন আজিরের মুখে আহার দিতে পারল না ছোবহান তখন রাগান্বিত হয়ে ক্রোধভরে আজিরকে উত্তম মাধ্যম শাস্তি না দিয়ে শান্ত হলো না। বিধবা দূর থেকে অতিথিদের পরস্পর ধস্তাধস্তি করা দর্শন করেই অবাক। সৃষ্টি ছাড়া অমুনুষ্যের কাজের জন্য ছোবাহান কে নিন্দা না করে কেহ পারলো না।  পরক্ষণে অত্যাচারিতা বালকের সামনে এসে সুমিষ্ট কন্ঠে বিধবা সুধালেন। বাবা কেন যে থালায় হাত রাখলে না তাহা জানার প্রয়োজন আমার নেই।  আমি ব্রতরুপে পরিজাত, তা বাবা তুমি যে মুসলমান, হালাল হারাম বেছে খাও, তাহা আমি জানি। কিন্তু বাবা এসব সামগ্রী অখাদ্য নয়” একটু থেমে বলল’ আমি ভাগ্য দোষে স্বামীহারা, তাই বিধবা ব্রত পালন করছি। কুচে কচ্ছপের ধারে ও যায়নি, নিরামিষ খেয়েই জীবনযাপন করি। একটু থেকে ইহা মুখে দিলে বাবা যাত যাবে না, বা মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বলেই আমার দিকে চেয়ে রইল। যুবক তার প্রতি বারাক ফিরে চাইলেই চক্ষু ফিরল না, কি করে গেল। পরক্ষণে মুখ ফুরাই অধ:মুখে প্রত্যুত্তরে করল” নি যাহা ভাবছেন তাহা নয়, মূলত মিষ্টান্ন খাবার আমার রুচিকার খাদ্যের বাইরে, কখনো ইহা আমি খাইনি।
   বিধবা____না হয় মানলাম মিষ্টি তোমার অপছন্দনীয় খাদ্য আমতো তাহা নয় কেবল তাহা পাতে থাকলো?
    যুবক___কথাটা যুক্তি সঙ্গত, আম আমার উপদেয় খাদ্য, তাহা আমি হাই, কথাটা মিথ্যা না! আমি আস্ত অখন্ড আম খেতে ভালোবাসি। বিধবার অনুরোধে যুবক এক টুকরো খাদ্য খেলো না । তখন তার পায়ের তলার মাটি ছিলো না। পরক্ষণে তার বিবৃতির শেষাংশে কিঞ্চিত বিদ্যমান হলে পুনরায় মাটি স্ব-স্থানে ফিরে আসে। জানতে পারলো আস্ত অখন্ড আম খুবই ভালোবাসে। বিরক্ত করল না তৎ খড়ি তড়িৎ বেগে নিজ শয়ন কক্ষে প্রবেশ করল। পরক্ষণে কতকটা আস্ত পাকা আম তার সম্মুখে রেখে দাঁড়ালো। যুবক একে একে আমগুলো খোসাসহ খেয়ে ফেলল, তাহা দেখে বিধবা অবাক হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পর তার অতিথি খানা জনশূন্য, একে একে সকলেই স্থান ত্যাগ করল। ঘন্টা দুয়েক পরের কথা, আখিরন বান্ধবীদের নিয়ে বিল ধারে বেড়াত গিয়েছিল। হিন্দু পাড়ার কোন এক অঘটন ঘটার সংবাদ শুনে ঠিক থাকতে পারলো না। তড়িৎ বেগে ছুটলো বাড়ির দিকে। গৃহ বধুর সমীপে হাঁপাতে হাপাতে বলল ভাবি” একটু দুঃসংবাদ আর কইতে পারলো না, কষ্টে দম আটকে যাচ্ছে। দৃহবধূ উৎকণ্ঠাই ছিল। দুঃসংবাদের হাতা নাতা পেল না। জিজ্ঞেস করল সংবাদটা বলেই ফেলনা! কিঞ্চিত প্রকৃতিস্থ হইলে, হিন্দু পাড়ার ঘটনা আংশিক ভাবেই শোনালেন ঢোক চিবিয়ে বলল অনুভবে বুঝলাম আমাদের মাস্টার নাকি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত?  মাহমুদ তখনো আমতারাই শয্যাই শায়িত, গৃহবধূর মারফথ ছোবহান কর্তৃক গৃহশিক্ষক আহত? শুনতেই লাফ ঝাপ দিয়েই ঘটনাস্থলে গেল।
    তথ্য সংগ্রহ করার পর উর্দ্ধশারে দৌড় দিল, ইহার বিধি ব্যাবস্থা করতে। মধ্যপথে গেলেই জনৈক ভদ্র লোককে দেখে গমনে ক্ষান্ত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহমুদের ফোর্স দেখে তিনি মনে মনে ভাবলেন এরা হয়তো কারুর উপর হামলা চালাবে। সেহেতু জানতে চাইলেন এভাবে কোথায় যাচ্ছ শুনি? মাহমুদ মনের আক্রোশ মনে চেপে স্বাভাবিকভাবে সহজ করল এবং জবাবে বলল সোবহানের খোঁজে যাচ্ছি।
    আগন্তক____এতইবা কিসের প্রয়োজন যে সদল বলে উর্দ্ধশ্যরে যাচ্ছ? উত্তর প্রত্যাশা না করেই বললেন তাকে দিতে আসলাম মাদ্রাসার মাঠে আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এই কথা শুনেই মাহমুদ সামনে অগ্রসর হইল না, মনে মনে ভাবলো আইন নিজহস্তে নেওয়া উচিত নয়। যাদের হাতে গড়া ছাত্র তারাই যখন উচিত শিক্ষা দেছেন তখন আমার তো আর কিছু করণীয় নেই। সকল আক্রোশ তার নিমিশে মিটে গেল। তৎঘড়ি করে পশ্চাতে ফিরে নিজালয়ে প্রত্যাগমন করলো।
           নবম পরিচ্ছেদঃ
    পিতার মৃত্যুদিনে। পিতৃ শোকে শোকাতুর  হওয়ায়  আখিরনের অবস্থা শোচনীয় হয়। সেই মুমূর্ষ কালে কুক্ষণে তার পর মুখ ইতে বের হল ভাবি। ইনি কি তিনি? শ্রুতি কটু কথা” বাহির হওয়ায়, কোথাও তার ঠাঁই নাই। তাতে সমাজে তার বিরুদ্ধে রং লাগিয়ে কত মিথ্যা অপবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সামনে কুৎসা রটনা না করে কেহ ক্ষান্ত ছিলনা। উল্টো ভ্রষ্টা মেয়ে বলে তাকে চুন কালি না মাখিয়ে কেহ ছাড়ল না।  সবার কাছে যে ঘৃণ্য, পচাফল যেখানে যায়  দুচ্ছাই করে।গাল টিপলে দুধ বের হয়, যেও। করে। গাল টিপলে কিনা বলেন। “ভাবি? ইনি ইনি কি তিনি? “লোকে হাত তালি দেয়, কারোর দুয়ারে যাওয়ার সাহস সংগতি রইল না। স্কুলে গেলেও শান্তি নেই। ছোটদের মুখ ভাঙছি সমবয়সী বান্ধবীদের মুখ ভাঙছি বয়স্কদের নাক শিটকানি শুনলে গা জলে। নির্লজ্জায়  মরিয়া হয়ে গৃহ শিক্ষকের নিকট পড়তে যাই। তাতে যে কত হাতা নাতা হচ্ছে সে তাহা জানেনা। মাহমুদ যেদিন শুনলো নিজের সহজ আর ভগ্নির সম্পর্কে পাড়ায় মিথ্যা রটনা হচ্ছে। তাহাতে বাতাস না দিয়ে নিজ ভাগ্নিকে হুশিয়ার করে দিল। আজ থেকে তোর মাস্টারের ঘরের ধারে যাওয়াও নিষেধ। ভাইয়ের নিষিদ্ধতার কারণে আখিরণ বাড়ির বের হয় না বটে তবে মনে মনে ভাবে নিজের ভ্রাতার কাছেও আমি শ্বাসিনি হলাম। এ দুঃখ কেমনে সইব,। বাড়ির বের হয়ে মুক্ত বাতাসে হৃদয়ের অসহনীয় তীব্র জ্বালা যন্ত্রণা নিবারণ করব সে পথও নেই।  কি করিব কোথায় যায় ইতস্তত করেই সে চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়ল। তাতে তার অন্ধর্দ্ধাই শুরু হয়। জ্বালা যন্ত্রণার দহনে সে দিশাহারা। পূর্বের মত আবোল তাবোল, ভুল বকা  শুরু করে দিল।
   গৃহ বঁধু আজন্ম ভড়কো মেয়ে। তদুপয়ী যখন-তখন আখিরনের বিভৎস দৃশ্য! সহ্য পায়না। নজর বুলাচ্ছে ছোট ননদের হার ভাব দেখে। পরক্ষনে মেঝো বুড়ি সহ গৃহ বধু ননদের কক্ষে হাজির। মেঝো বুড়ি দুর থেকে মন্তব্য করলো, “জ্বর বেরামের ঝালে এসব তাল-বাহানা” গৃহবধু  তৎঘড়ি স্বামী দৃষ্টি আকর্ষন না করে পারলো না।
     রোগীর কাছে কেবল মাত্র মেঝো বুড়ি। ভাসুর-ঝির নিকট জানতে চাইল “মাগো লুকোচুরি করিসনে, সত্যি করে বলো, তুমিতো ভাল মানুষ।  খাও দাও, পড়া শুনা করো। হটাৎ করে বিশ্রী কাণ্ড ঘটায়ে এভাবে পাড়ার মানুষ যোগাড় করো কেন? তোমার মনের কথাটা শুনতে চাচ্ছি? সেঝো বুড়ির মুখে চুপে চুপে কথাগুলো শুনে, আখিরনের ইচ্ছা গুলো মনের অজানা গোপন কথাগুলো ফাঁস করে দেয়। ইতস্ততঃ করেই শয্যা ছেড়ে যেন নিয়োগ ভাবে মেঝো বুড়ির কানে কানে বলল” মেঝো মা, মাষ্টারকে আমার চোখে ভাল লাগে, অনেকদিন থেকে তাঁকে ভাল বাসি। তিনি কিন্তু ধরা দেননি। কতভাবে ভুলানোর চেষ্টা করলাম, তার মন পেলাম না। ইতিপূর্ব্বে যতটা সম্বন্ধ, আসল, সকলেরই একই কথা, মেয়ে দৃষ্টি ধারী, রুপে-গুনে পরিপার্টি, মাতৃহারা কন্যা বলে, পুছতেও চায়না তাই আকৃষ্ট হয়েছি। পিতার মৃত্যুর পর অন্ধকার দেখছি। তাতে অন্তর্দাহ আকাশের তারা গনে বিনা সুতার মালা গাথলাম কার বগলে পরাবো বলতে বলতে বুড়ির গলা জড়ায়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে সে কান্না শুরু করলো।
   মেঝো বুড়ি তাকে কত বুঝ পোড় দিয়েই, কক্ষের বাইরে “পা” রাখলেই পাড়ার মেয়েদের আগমন প্রত্যক্ষ করলো। তিনি নিঃশব্দে সিংহ দ্বারের বহির্ভূত। গৃহবধুকে বলে যান বৌমা, মাষ্টারকে ডেকে একটু ফুঁক ফাঁক দিলে ভালো হত।  খানেক পরে মাষ্টার রোগীর কপাল দেশে হস্ত রেখে বুঝলেন, এর মনের রোগ না জ্বর বিগারে ভুল বকছে। মেয়েরা স্বভাবতঃ বোধে হাল্কা, কার কি বলে তাহা ঠিক করতে পারেনা। আখিরনের গায়ে জ্বরে কাঁট ফেঁটে যাচ্ছে। মহিলারা কাছে চুপে চুপে বসে বিপরীতভাবে নানা জনের নানা কথা। কেহবা বলে, জীনের দৃষ্টি, কেহবা বলে মনের রোগ। আর কারোর মন্তব্য মেয়ে হাই স্কুলে পাঠালে এই রকম হয়। তাদের লেখাং পড়াং বিবাহের কারনাং। কারোর বা অভিমত এসব মন্তব্য ভুল। পিতৃহারা বৈমুখ হলেই আখিরন চোখে দেখছে। ভবিষ্যতের আশা-ভরসা সবই নৈরাশ্যময়। সেই দৃশ্য যখন মনের পাতায় ভেসে ওঠে, তখন এর চিত্ত বৈকল্য হয়। অন্তর্দ্ধাহের উদ্রেগ হয়, সে নিমিত্তে এখন বিভৎস বিকৃত মূর্তি পরিদৃশ্যমান ঘটে। তাদের কথাবার্তা অব্যাহত থাকতেই ডাক্তারসহ মাহমুদের প্রবেশ হলো। ডাক্তার যাবার বেলায় বলে যান টাইফয়েট জ্বর, কেস মারাত্বক, রোগীর গায়ে যেন আলো বাতাস না লাগে।
    সুযোগের সদব্যাবহার কেহ কেহ ছাড়ে না। মাষ্টার ইতিপূর্বে মেয়েদের মন্তব্য নিরবে শুনে আসছিলেন, শেষে যেন কেহব অস্পষ্টে বল্লো এর এখন সব কূলই খোয়া, জের টেনে কথা শেষ না হতেই মাষ্টারসহ মাহমুদের আগমন দেখে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে পারে নাই।
এইক্ষনে ডাক্তারের বিদায় অভ্যর্থনার পর ধৈর্য ধারণ করতে পারল না। মহিলাদের লক্ষ্য করে বলল” রমণী জাতটাই স্বভাবত খারাপ। এরা বোধে হালকা। যারা ঘরের কথা পরের কাছে কয় তারা কি ভালো? পরের দোষ না ঘাটলে তাদের পেটের ভাত হজম হয়না। রোগী এখন তখন, গায়ে জ্বরে কাঠ ফেঁটে যায়, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে, তোমরা তোমরা ভাবছো তার বিপরীত। সামান্যতম কারোর দোষ ঘাট পেলে তার হালিশ নাড়ি বের না করে ছাড়েনা। কারোর দোষ গোপন না করে লোক সমাজে প্রকাশ করিলে তাহাতে সমাজে মানুষের মাঝে আসে অশান্তি।
    সংসার সুখি হয় রমনীর গুনে, নারীরা সুন্দরী হয় তার আচরণে। কুক্ষনে আজ অনিচ্ছায় নীতিবাক্য না বলে পারলাম না, তাহাতে আমি নিজেই অনুতপ্ত অনুশোচিত, এর জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।
   দশম পরিচ্ছেদঃ
    ভ্রাতৃ নিষধাজ্ঞা পালনার্থে আখিরন বাড়ির বের হয় না। মাস্টারের বাসায় পড়তেও যায় না। এমনকি স্কুল মুখেও হয়না। দিবানিশি সে বাড়ির সীমা রেখার মধ্যেই পড়াশোনা করে। ইহাতে। মাস্টারের আপত্তি, তার পড়াশোনার নিমিত্তে বাড়ির মালিক স্ব-ইচ্ছায় আমার কাছে পাঠিয়েছে।সে কেন ঘরের বের হচ্ছে না, এখানে পড়তেও আসে না, এতটুকু ব্যতিক্রম তো সন্দেহের কারণ! নিশ্চয় কিছু না কিছু ঘটে যাচ্ছে। চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়েন, লেখাপড়ায় মন বসে না। হাতের বই পর্যন্ত দূরে ছুড়ে দিলেন। হন হন করে মাস্টার ঘরের বাইরে গেলেন। সকাল আটটায় আখিরন পড়াশোনা শেষ করে হাতের কাজ করে। ইতিপূর্বে গৃহশিক্ষক কখন যে তার দুয়ারে এসে খাঢ়া এ খবর সে রাখেনা। যখন সে সুচের সুতা পরাচ্ছে অসাবধান মুহুর্তে তার চোখ পড়ল দুয়ারে। দেখেই থত মত। চেয়ার ছেড়েই বসতে বলে, সে ঘাটের উপর আসন নিল।
     মাষ্টার জানতে চাইলেন “আখিবন আমার বাসায় তুমি কেন পড়তে যাও না? কিংবা দিতেও যাচ্ছ না? ব্যাপারকি? এর মধ্যে কোন কিছু” আছে। তাহা জানার প্রয়োজন।
     আখিরন মনে মনে ভাবে, প্রশ্নের জবাব তো দুরুহ, এটা কাভ্যন্তরীন ব্যাপার। নিজের আভ্যন্ত কেমন করে বাল? যে কথা বলাও যায়না। জানতে যখন আসলেন তখন নিশ্চুপ থাকাও যায়না। মুখ তুলে জবাব দিল, এমন তো কোন বাধা বিঘ্ন- নেই, নিজেই যাচ্ছিনে। ঢোক গিলে বলল, পুরাতন পড়ার জন্য কারোর কি সাহায্যের প্রয়োজন হয়? তাই বাসায় শুয়ে বসে পূনরাবৃত্তি করি।
    গৃহশিক্ষক্ষক ____”না হয় মানলাম, পুরাতন পড়ার জন্য কারোর সাহায্যের দরকার হয়না, কিন্তু খাবার দিতেও তো যাও না। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটছে? ইতিপূর্বে ছোকরা তো আমার সম্মুখে ও আসত না? আজ কেন তার দ্বারাই খাবারাদি বয়ে দেওয়া হয়? এর মধেং কোন গুঢ় রহস্য না থাকলে ব্যতিক্রম ঘটত না। তুমি গোপনই রাখলে, “বলেই বিষণ্ণ বদলে প্রস্থান করেন। গৃহ শিক্ষক্ষকের প্রস্থানের পরক্ষনে আখিরনের মনে আঘা লাগে। মনে মনে ভাবে পড়তে না যাওয়ার কারন জানতে এসেই তিনি বিষন্ন, বদলে ফিরে গেলেন। এটা অত্যান্ত দুঃখ জনক। কেন গোপনী ভাঙলামনা? এতে, তিনি যেমন লজ্জিত, তদ্রুপ অনুতপ্ত। তাকে কেন্দ্র করে আমার বিরুদ্ধে কতনা নিন্দাবাদের ঝড় বয়ে যাচেছ। সমাজে কলুষিত, ঘৃনারুপে পরিগনিত হলাম। যার কাছে গমনা গমন লোকের দৃষ্টি কটু। ঠাট্টা বিদ্রূপ উপহাষপদ হয়ে নিন্দনীয় হয়ে  নিঃপীড়িত হচ্ছি? তার কাছে লুকোচুরি কিশের? হৃদয় পটে কত প্রশ্ন ভেসে ওঠে। রাত্রে গভীর, ধীরে ধীরে সে বাড়ির বের হল। মাষ্টার তখনও পাঠরত, নিঃশব্দে তার পাশে দন্ডায়মান, তিনি ঘাড় ফেরায়েই বিস্মিত।  আখিরন এত রাত্রে?
    প্রযোজন আছে বলে এত রাত্রে? মাষ্টার সন্নিগ্ধ হলেন, জানি না তার কোনো অভিপ্রেত আছে কি না? আশ্চার্যন্বিত হয়ে বলেন, এতই কি প্রয়োজন যে এত নিশি-রাত্রে ঘর থেকে বের হলে? ছাত্রীবলল__  “তাই বলে কোনো প্রবৃত্তির মোহে ঘরের বাহিরে পা কাড়ানি। কেবল মাত্র আপনার সেই সকাল বেলার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে না পারায় চোখে ঘুম নেই। তাই নির্লজ্জায় নিরুপায়ে আসলাম সকল কথা-প্রকাশ করাতে।” পরে নিজের ভূত অবিষ্যৎ-সম্পর্থে আত্মা হুতি। “স্যার আমি অন্ধকারে পথ দেখতে পাচ্ছিনে। আপনি আমার অন্ধকারের আলো স্বরূপ। সকল অভরসার ভরসার স্থল। একবার বলুন তুমি আমার, আমি তোমার।” বলেই আপাৎদৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
    মাষ্টার বুঝলেন, পিতার-মৃত্যুর পরে, এমনি ভাবে সমাজে নির্য্যাতিত হচ্ছে। তাতে তার ভবিষ্যতের আশা ডরসা নেই, জীবন ভর লোকের কথার খোঁচা না খেয়ে অগ্রেই অন্ধকারে পথ চলার স্বপ্ন দেখে পরলাপ বকছে এইভেবে। “আখিরন, তুমি বড় ছেলে মানুষ। দুনিয়া সম্বন্ধে তোমার হিতাহিত জ্ঞান খুবই কম, তাই সহজেই ভেঙ্গে পড়েছো। তুমি যদি অবহিত হতে তবে বুঝতে, হাসির চেয়ে কান্নার দামই বেশি। গ্লানি অপেক্ষা আত্মসংবরণী অধিক মূল্যবান। জেনে রাখো, আকাশের চন্দ্র সূর্য যে সত্বার আদেশে ওঠে ডুবেও তারই নিয়ন্ত্রণে। আঠারো হাজার মাখলুকাত নিয়ন্ত্রিত। এধরা শুধু বিষাদময় না, সুখ দুঃখ বিজড়িত।
একটু থেমে>>>> কখনো ভেঙ্গে পড়ো না, মনের সকল খেয়ালী অভরসা দুরিভুত করে সৈয্যের আশ্রয় নাও। অন্যথায় কেহ আশাতীত সাফল্য লাভ করতে পারেনা। ভাগ্য প্রসন্নও কারোর হয়না। আমার বক্তব্য শেষ, রাত্র অধিক হয়েছে এখন বাড়ি যাও। এভাবে নির্জন নিরালায় কিশোরী তরুণ তরুণীর আলাপ করাও দোষের। এতে অসভ্যতা প্রকাশ পায়” আখিরন গভীর মনোযোগ সহকারে তাদের প্রজ্ঞা পূর্ণ উপদেশাবলি শ্রবণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করল। তার বক্তব্যে” ধৈর্য সহ্য কথায় নিজের ব্যাক্তিত্ব অভিমত সামান্যতম ইঙ্গিত নিহিত। অনুভবে বুঝে সকল অভরসা তার মনে পট থেকে মুছে গেলো। নিমিষে ফুটে উঠলো হাস্যরেখা স্বপ্নরাজ্যের জীবন সাথী তার হৃদয় থেকে স্থানান্তরিত হলো।
                একাদশ পরিচ্ছেদঃ
    মাস্টার আজির এবার আলেম ক্লাসের পরীক্ষার্থী, নির্বাচনী পরীক্ষা আসন্ন, বেশি দেরি নেই। আখিরন তখন অষ্টম শ্রেণি পার হয়ে নবম শ্রেণীতে উঠার স্বপ্নে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এইক্ষনে শরৎ কালীন অবকাশে তিনি নিজ বাড়ি গমন করেন নাই। অধিকাংশ সময় তিনি বাসায় শুয়ে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করে যাচ্ছেন। তৎকালে কোন একদিন, মধ্যাহ্ন ভজনের পর, শয্যায় শায়িত, পুস্তাক তার হাতেই আছে। সহসা আখিরন এমন এক মনোহর রূপ লাবণ্য নিয়ে তার কক্ষে আগমন করলো তাহা দৃষ্টি আকর্ষণীয়।
ভাদ্র মাসের ভরা নদী জলের মত এর রুপ রাশি টল-মল করছিলো। সেই সৌন্দর্যের রূপ রাশি পূর্ন যৌবন ভরে সারা অবয়ব যেন ঈষচ্চঞ্চল চঞ্চলতার চাহনী, সে চাঞ্চল্য মুহুর্মুহু নতুন শুভা বিকাশের কারণ, পূর্নচন্দ্র কোসুদীর ন্যায় তার রুপচর্যা। সে দৃশ্য দর্শনে কারোর মন না টলে পারে না।
    রক্ত মাংসের গড়া মানুষের মনে যে রং ধরবেনা এর নিশ্চয়তা নেই। মুহুর্তে তার মনোবল ভেঙ্গে গেল, পড়াশোনা শ্রম সাধনার পথসমূহ বাধা বিঘ্ন ভেবে বুঝালেন। তথাপি আখিরনকে সভ্যতাই গড়ে তুলতে পারছেন না। সামনে যে স্থির হয়ে পাঠ অভ্যাস করবে সে মনোবল রইল না। গত্যান্তরে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারলেন না। ফলে তার এখানে আগমন করাও নিষিদ্ধ হয়ে গেলো।
     চোরের মন পুলিশ পুলিশ, সুযোগ সন্ধানে সর্বক্ষন থাকে। তাতে তার উৎপরতা দেখা যায়।
সচ্ছ মরোবরে, সচ্ছ জলের মত পূতঃ পবিত্র প্রেমের আবির্ভার হলো, মানলোনা কোন বাঁধা। ছুটে চলে যেন বলগা হীন হরিনীর মত দিক বিদিক জ্ঞানহীন প্রেম যেন অনবধান।
সন্ধ্যা না হতেই আখিরন, নিজের বাসায় আলো জ্বালিয়ে প্রত্যহ পড়া শুনার প্রস্তুতি নেয়। ইহাতে কারোর কড়া দৃষ্টিন থাকেনা। পরিবেশ পরিস্থিতি আনুকূল্য দেখে যে অলক্ষ্যে গৃহ শিক্ষাকের দুয়ারে গিয়ে হাজির হয়। পরক্ষনে হৃষ্ট চিত্তে সজাগ সতর্কভাবে সে ফিরে এসে নিজ কর্তব্যে মনোনিবেশ করে।
     প্রনয় এই রূপ প্রনয় কর্কশকে মধুর করে, অসৎ কে সৎ করে, অনুন্যকে পূন্যবান করে, অসম্ভব কে সম্ভব করে। দুর্ভেদ্য বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে মাঝে মাঝে যখন গৃহ শিক্ষককের
গৃহশিক্ষকের বাসার দুয়ারে গিয়ে দাড়াতো, তাতে মাষ্টারের মনে ধাক্কা লাগত। ইচ্ছা হতো কাছে বসায়ে তার রুপের সুরভী ঘ্রানে মন পরিতৃপ্তি করি। পলকের মধ্যে সংযত হয়ে মনে   ভাবে এ বয়ষ, বসন্ত সম সুখ ভোগের সময়। তবিয়ত কারোর ঠিক থাকে না। পিচ্ছিল পথে কারো না কারোর পা সরে। কিন্তু যুবক যুবতীর পদস্খলন ঘটে । আমার যে সরবেনা তার নিশ্চয়তা নেই। সেহেতু নিজের ইতিহাসে কলঙ্কের দাগ না পড়তেই মাষ্টার অন্যাত্রে যাওয়ার ব্যাবস্থা নিলেন। বাড়ীর সবাই ঘুখালে অঙ্গাতসারে সে তড়পী তড়পা গুটায়ে পূর্বের লজিং এ আশ্রায় নিল। যাকে কেন্দ্র করে আখিরন  প্রতিনিয়ত ভাবা চিন্তা করতো, মনে মনে কল্পনার তুলি স্বপ্ন ঘৌধ আঁকত। এক পলকে তা ভেঙ্গে খান খান। অকূল দরিয়াই হাবু ডুবু খাচ্ছে। অনন্ত সাগর পাড়ি দিবার খেয়া পারাবার নেই। চোখে অন্ধকার দেখল, সবই অভরসা।
       দ্বাদশ পরিচ্ছেদঃ
     একদা নেংগুড়া বাজারে রব উঠলো আজির লজিং থেকে উধাও। খানা তল্লাশি করে দেখা গেল বাসায় কিছুই নেই গৃহ শুন্য। তথ্য সংগ্রহে জানা গেলো গৃহশিক্ষককের প্রতি ছাত্রীর মোহাচ্ছন্ন হওয়াই মাষ্টার থাকতে পারে নাই।  কড়া শাসনের মধ্যেও তাকে বিরক্ত করত, তাতে, তার কর্তব্য কর্মে বেঘাত ঘটত। তদুপরী কলঙ্কের ছাপ গায়ে না লাগিয়ে এই উদ্যোগ নেই। একদা আখিরন বিকাল বেলায়  বান্ধবীদের সাথে নিয়ে বিল ধারে বেড়াতে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় বিলের অপর পারে মসজিদ হতে আসরের আজান ধ্বনি উচ্চারিত। যার খেয়ালী মন সর্বক্ষন ডালে ডালে, তার কান সর্বদা সজাগ থাকে। সেহেতু সেই সুর কানে ভেসে না আসতেই আখিরন বিস্মিত। মনে মনে ভাবল, এস্বর যেন চেনা চেনা ভাব। অবিকল মাষ্টারের কন্ঠস্বর। তাওবা কি রূপে বলি? তিনি যে, নিখোঁজ ও মাদ্রাসা হ’তে বাওড় পার তার নিজ গ্রামে সন্ধান নিয়েও তার খোজ খবর পাওয়া যায়নি। উৎকন্ঠে রইল বহনক গভীর মন সংযোগে শুনছে, আজানের শব্দে যেন খাদ নেই। ইনিই তিনি। তড়িত বেগে-বাড়ী এসে গৃহ বধুকে বলল, “ভাবি” মাষ্টার হয়ত এখনও বাজারে। ইতি পূর্বে আজানের শব্দ অবিকল মাষ্টারের কন্ঠস্বর” মাহমুদ তখন কার্যরত ছিল। গৃহিনীর চাপে তিষ্টিতেপারে নাই। তৎঘড়ি প্যাকেটটা লয়ে বাজারের পথে রওনা দিল। মধ্য পথে গেলেই সামনাসামনি দেখা সাক্ষাৎ। মালাম বিনিময়ের পর, সকল ঘটনা ব্যক্ত করে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেই বর্তমান লজিং অভিমুখে ফাত্রা করলেন, যাবার বেলায় বলে গেলেন “ভায়া” হাটে যান যান, আমি ফাল সভায়া, , আমি কাল বাড়ি যাওয়ার পথে বেড়ায়ে যাব।
     পরদিন ছুটীর পর, সে আখিরনের বাসায় এসে জোহরের নামাজ সমার্পন করে।  আহারান্তে কৈফিয়ত দিল, অনেক অসুবিধার কারনে লজিং পালটানো হয়েছে। এখন সাবেক লজিং এ আস্তানা গাড়ছি। আর ফিরে আসা যুক্তি যুক্ত নহে। গলা আর ফিরে আসা যুক্তি যুক্ত নহে। গলা জড়ায়ে কাঁদলেও আশানুরুপে পাইবে না। বলেই ধীর পাদ বিক্ষেপে সিংহদ্বারের বাইরে এলো। পরক্ষানে কি মনে করে থমকে দাড়ালো। তাহা দেখে আখিরন প্রার্থনা করল, তড়পি তড়পা লয়ে ফিরে আসলে যদি যাত যায়, তবে বাধা দেবনা। কিন্তু কেবল মাত্র দাবি, রাত্র টুকু থাকেন, বলেই মাষ্টারের জামা ধরে দাড়ালো।  তিনি অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। তৎঘিড় ছাত্রীর পশ্চাৎ বর্তী হলেন।
    সেদিন রাতের আহারের পর, গৃহশিক্ষক ও ছাত্রী আখিরনের মধ্যে স্বপক্ষো বিপক্ষে অনেক বাক্যালাপ হয়। তাতে দেখা গেল, আখিরনের মনোভাব অনুকূল না। প্রত্যেকটি কথায় তার রশিকতা। তার একই কথা মাঝে মাঝে এই রূপে যদি দেখা সাক্ষাত না দেন, আমি বাঁচব না। আপনার অদর্শনে কখন যে কি ঘটবে, তা, বলার অবকাশ রাখে না। মআষ্টার তাকে তিরস্কার করে বলেন, “আখিরন” তুমি এত নিছ” কল্পনাও করতে পারি নাই,” একটু থেমে এমন কথা কিরূপে মুখের বাহির করলে? লজ্জাও করল না? আখিরন হেসে উত্তর করল, ” অমন কথা আমি বলি নাই। বলেছে আমার প্রেম।
    মাষ্টার___ যে প্রেম এত সহজে পড়ার প্রতি বিতৃষ্ণা ঘটায়, সে প্রেম, প্রেম নয়।  প্রেমের বেশে মোহ” সেহেতু না বলে পারিনা। তোমার মতিচ্ছন্ন ঘটতে বাকি নেই। লজ্জা শরম যে কি জিনিস তাহা তোমার মধ্যে নেই। একটু পরে  পাশ ফেরায়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন সকালে যাবার বেলায় একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় গ্রহন করার পর আখিরনকে একান্তে ডেকে বলেন ” আখিরন” তোমার সারা রব রবে  নিরীক্ষান করে অনুভবে বুঝি” পিচিছল পথে কখন যে তোমার পা সরবে, তাহা ঠাহর করতে পারবেনা। আশায় বুক বেঁধে লাভ নেই। একটু থেমে বলল,  হ্যাঁ যাই যে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধারণ করতে পারো। সতীত্ব বজায় রেখে থাকতে পাঁর? তবে পবর ছড়ার মত দু’পায়ে ঠেলে দেবনা, বলেই প্রস্থান করেন।
        ত্রয়োদশ পরিচ্ছেঃ
     একদা আজির পূর্ব লজিং এ আসার পর, বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। ফিরতে রাত্র অধিক হয়। তথাপি নিঃসঙ্গ ভাবে তিনি পদ বুজে চলছেন। কিছু অগ্রসর না  হতেই পথ প্রান্তে বিরাট এক ঘন আম বাগান। গমন কালে, সে স্থান থেকেই দুজন লোকের চুপে চুপে কথা বার্তার অস্পষ্ট কন্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসছে বটে কোন ভ্রুক্ষেপ করলোনা, ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি হচ্ছেন। পশ্চাত্তে কারো পায়ের শব্দ শ্রমন করে ফিরে তাকান। অন্ধকারে কাওকে ঠাহর করতে পারলেন না। জীন ভূত, কিংবা মানুষ তা দেখার নিমিত্তে গমনে ক্ষান্ত দিলেন। আকাশে বিদ্যুৎ চমকিত,  রাতের আধারে কালো ছায়া মুহুর্তে সরে গেল। পল্লব ঘন আম্র কাননে, সে আলোর কিরন প্রতি ফলিত হলেও তাহা অস্পষ্ট ঘোলাটে। তিনি আফছা আধারে দেখলেন তাদের একজন চেনা পরিচিত  আরেক জন অচেনা লোক। তৎপর গন্তব্য পথে অগ্রসর ইচ্ছেন। সহসা দুপ দপ শব্দ শ্রবণ করে থমকে দাড়ান। অজ্ঞাত নিশাচর পুরষের মুখে আপন নাম শুনেই অবাক হলেন, কিছু ভিতুও হলেন। সহসা প্রশ্ন করলে, কোন উত্তর তার মুখ হতে বের হলো না। জ্ঞাত ব্যক্তি পূনরায় জিজ্ঞাসা করলেন” তুমি আমাদের কথা কর্তা শুনেছ কি?
     জিনি উত্তর না দিয়ে বললেন,” আমিও জিজ্ঞাসা করছি, এ কানন মধ্যে তোমরা দুজনে এহেন নিশিথে কি  কু-পরামর্শ করছিলে ?” আগন্তুক কিছুক্ষন নিরুত্তরে চিন্তামগ্ন রইলেন। কোন নতুন হৃষ্ট সিদ্ধির উপায় চিত্ত মধ্যে উপস্থিত হয় কি না, এই ক্ষনে আরও কতিপয় তরুন যুক ছাত্র তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি ভয়ার্ত বুঝে তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। তারা তারা তার শঙ্কিত ভাব অনুভব করেই অভয় দিয়ে বলল, তোর ভয় নেই। তবে একটা কথা”  “আজ তোরও আলো মতি প্যান্ডেলে যাওয়া লাগবে, সাধু সাধিসনে।
   গানের আসরের নাম উল্লেখ করতেই আজির শিওরে ওঠে, জীবনেও কোনদিন ঐরূপ অনুষ্ঠানে যায়নি। আর আজকে যাকে! কিরূপে রক্ষা পাবে তার কৌশল অন্বেষনে ব্যাপৃত। কিছুক্ষান চিন্তার পর, আত্মরক্ষার কোন উপায় না দেখে নিরুপায়ে করজোড়ে আত্মসমার্পন করতে বাধ্য হলো। করজোড়ে সকাতরে কতনা অনুনয় বিনয় করে বলল”মোস্তফা” আমি ক্ষমা প্রার্থী। আমি জীবনেও ঐ পথে পা বাড়ায় নি; আজও বাড়াতে অনিচ্ছুক।
     মোস্তফা ___” ক্ষমা? যতই চোখের জলে বুক ভাসাও, ক্ষমা হবে না ।। বলেই সজোরে বল প্রয়োগ করে তার হস্ত-পদ বেঁধে ফেললো। গানের আসরের কথাটা শুনেই আজির করজোড়ে সকাতরে কতনা অনুনয় বিনয় করলো। তাহাতে কারোর মন গললোনা, ক্ষামাও পাইল না। জোর পূর্বক হাত-পা  বন্ধন অবস্থায় তাকে সঙ্গে তুলে তথাস্থ গমন করলো।
    সরু পদে পুকুর পাড়ে না জেতেই হাটুরে লোকের কানে একরূপ গুম গুমে আওয়াজ শুরু হয়। তাহাতে তারা চমকিত। বলা বলি করলো কিসের-শব্দ? চক্ষু ফিরায়ে দেখলো আফছা আধাঁরে কালো ছায়ায় কারা যেন অগ্রসর হচ্ছে। মনে হচ্ছে লম্বা চওড়া জিনিষ। উচ্চস্বরে বললো, “কে তোরা?
হাটু লোকের কন্ঠস্বর শ্রবণ করে তারা ভীত হয়ে পুকুর পাড়ে আজিরকে দড়াম করে ফেলে উধাও। তাতে পথিক দের আক্কেল গুড়ুম। সাহসে ভর করে তথ্য সংগ্রহে তারা তৎপর ইলো।
      অবশেষে পুকুর পাড়ে কাশবন থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। বন্ধন খুলতেই দেখল যেন মুখে গামছা গুজা, তাহা বের করতেই মুখ থেকে কুলি কুলি রক্ত বের হচ্ছে। তাহা দেখে  আতঙ্কিত হলো।
    পরক্ষনে হাটুরেরা আজিরকে নিকটতম কারোর বাসায় নেওয়ার মনস্থ করলো। যে কথা সেই কাজ,নিকটস্থ বাড়ীতে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এবং গৃহ স্বামীকে জাগ্রত করে, পথি মধ্যের দুর্ঘটনা বর্ণনা করে শুনানোর পর, “স্বাবধানে রাখবেন” বলেই তারা নিজ নিজ বাড়ি অভিমুখে যাত্রা করলো।
   অনেকক্ষন পর জ্ঞান ফিরলে পাড়ার সাথী ভাইদের সহায়তায় বাড়ী পৌছে গেল। যথা সময়ে আজিরের মর্মান্তিক ঘটনা
কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হলে, ইহার প্রতি বিধানের জন্য যথা বিহিত ব্যাবস্থা গ্রহন করা হলো। এবং তাহাতে মোস্তফাকে বহিষ্কার করা হলো। এবং কাকি দোষী ছাত্রদিগকে সমুচিৎ শিক্ষা দেওয়া হল।
        চতুদর্শ পরিচ্ছেদঃ
    সম্প্রতি আখিরন ভালো হয়ে চলে, উৎশৃংখল- মনোভাব তার আচরণে নেই, সে এখন নিয়মিত ভাবে পড়াশুনা করে। স্কুল থেকে এসে বান্ধবীদের সহিত খেলে বেড়ায়। এতে সবাই খুসি, কিন্তু কেবল মাত্র একটা দোষ সঙ্গ সাথী। প্রত্যহ সে সঙ্গ সাথী বান্ধবীদের সহিত বিলধারে যায়। ইহা লোকের কাছে খাঁরার, দৃষ্টি কটু। খোলা মাঠে রাস্তার পার্শ্বে বসাটা অশোভনীয়, এতে অসভ্যতা প্রকাশ পায়। সেহেতু কর্তৃপক্ষের উপর সমাজের কঠোর চাপ। তড়ি ঘড়ি করে আখিরনকে বিয়ে দেওয়া দরকার। তাহাতে মাহমুদের চোখে ঘুম নাই।
     ইতি পূর্বে যতটা সম্বন্ধ আসছিলো “মাতৃহারা” কন্যা বলে রাজী হয়নি। আর যে আশায় এর শিক্ষা দিচ্ছি। তারও সামনে দু-বেড়া অর্থ্যাৎ ফাজিল পরীক্ষার আগে বিয়ের কথা যুক্তি সঙ্গত না। ইহা অনুচিৎ ভেবে সমাজের চাপে মাহমুদ নিরুপায়ে ভগ্নিকে আগেই পাত্রস্থ করার
সিদ্ধান্ত নিল রইল। সেই নিমিত্তে সে চেষ্টায় রইলো, কিন্তু তার বিবেকে ধাক্কা দিলো, আববা যাকে মনোনীত  করে রেখেই কবর দেশে গেছেন তাকে অন্যত্রে পাত্রস্ত করার যায়না।তথাপি সমাজের চাপে বয়স্কা ভগ্নির বিয়ে না দিলে নিজের জীবনে নিরাপত্তা নেই।  রাজনীতি খপ্পরে না পড়তেই আখিরনকে পাত্রস্থ করা যুক্তি যুক্ত। বহু  চিন্তা ভাবনার পর, “মাহমুদ” পুনরায় পদক্ষে নিল বটে যেখানে যায় বিমুখ হয়ে ফিরে আসে, যোগ্য পাত্র মেলেনা। দু-একটা সম্মন্ধ খুজলে যদিও মিলে, তারা আয়ক্ষন না হলে বিয়ে করবেনা। তথাপি সে হাত ধুয়ে নিশ্চুপ নয়।
   পিতার মৃত্যুর পর, ভগ্নির প্রতি ভ্রাতার কর্তব্য পাত্রস্থ করা। নিজ কর্তব্য পালনে সর্বদা সজাগ, সতর্ক। পাত্র অমিল হলেও হাল ছেড়ে দেয়নি, দৈহিক মানসিক দিক থেকে যতটা প্রচেষ্টা চালানো যায়, কোনোটারই সে ত্রুটি করেনি। তার একই কথা আজ না হোক, কাল এর যোগ্য বর মিলবে। এত টুকু বিশ্বাস আছে, সহসা খবর হলো, খালাতো ভাই আখতারের মুদি খানার দোকানে তাকে এক্ষনি দেখা করতে হবে। মাঠে কাজের চাপও কম না, তদুপরী আখতার বয়সে অনেক বড়, বড় ভায়ের ডাকে সাড়া না দিলে বিয়াদবি প্রকাশ পায়। মানবতার খাতিরে মাহমুদ মাঠের কাজ ফেলে তৎঘড়ি পথে বের হয়ে পড়ে।
     যথাসময়ে মাহমুদ আখতারের দোকানে পৌছালো। উভয়ে পরস্পর সাংসারিক আলোচনার পর আখতার মাহমুদকে বললেন আখিরনের বিয়ের জন্য দোকানের সামনে বসা যুবককে নির্দৃষ্ট করা হয়েছে,  ওদের একই কথা
মেয়ের দেখা লাগবেনা। ছেলে ঘরে ভালো আচরন ও মন্দনা , তাহাতে তোমার আপত্তির কোনো কারন নেই।
    মাহমুদ বললো——“ভায়া! আপনি  বয়জৈষ্ঠ্য, আপনার চোখে যদি ভাল লাগে, তাহাতে স্নাপত্তি নেই। আখতার বলল, তাহলে বিয়ের দিন নির্দৃষ্ট করা হোক।
   মাহমুদ —–আগামী মাসের বিশ তারিখে রোজ বৃহস্পতিবার হলে বোধ হয় শুভ হয়।
আখতার——-আমারও ইচ্ছে কোন এক বৃহস্পতিবার  দিন ধার্য্য করা। কাজেই তোমারই নির্দৃষ্ট দিনই বহাল থাকুক। একটু থেখে মাহমুদ বললো যাত মান যেন থাকে, ঠিক মত নাস্তাপানির ব্যবস্থা না করলে, আমার সন্মান বিনষ্ট হবে।
    সে দিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিয়ের দিন ধার্য্য করেই মাহমুদ বাড়ি আসলো, বিয়ের কথা কাওকে না বলে সে আপন বুদ্ধিতে সম্পূর্ণ গোপন ভাবেই প্রগরহন করছে। কেননা
জানতে পারলে কুটনীতিতে পন্ড হতে পারে।
এই জন্য আখিরনের বিয়ের কথা কাওকে বলছেনা। বাড়ীর পরিবেশ পরিস্থিতি ভিন্ন রুপ দেখে আখিরনের মনে সন্দেহের উদ্বেগ হলো। মনে মনে ভাবে এত তোড় জোড় কিসের ? এ যেন বিয়ের অনুষ্টানের আয়োজন।  কয়েকদিন পর সে স্থির থাকতে পারলনা, গৃহবধুকে ডেকে বললো আয়োজন কি জন্য হচ্ছে? শুনতে ইচ্ছুক।
    গৃহবধু জবাব দিলো, আমামাদের উপর সমাজের বিরাট চাপ, তুমি সবার কাছে দৃষ্টি কটু, কারোর দুয়ারে যাবার মুখ নেই। সেজন্য গোপন ভাবে তোমাকে বিয়ের দিন ধার্য্য করা হয়েছে, তাই এত আয়োজন। বিয়ের কথা শুনেই আখিঁরনের মাথায় বজ্রাঘাত হলো। মনে মনে স্থির করল, এ বিয়েতে সে বিয়েতে সে মত দেবেনা। কিন্তু বিয়ে বন্ধ করার উপায় কি? একবার সে মনে করলো, ভায়ের সম্মুখে নিজেই বলি। কিন্তু সে সৎ সাহস তার নেই। দ্বিতীয়তঃ লজ্জ শরমে পাই ওঠেনা, ও পথে কাটা দিয়ে অন্যভাবে চিন্তায় থাকে।
 এবার স্থির করলো, ভাবির মারফত ভাইকে সব কথা খুলে বলবো, এ বিয়ে বন্ধ করা হোক।
সেদিন রবিবার, ভাবির শরীরটা জ্বর জ্বর বারান্দায় শুয়ে ঝি দ্বারা কাজ করাচ্ছে। তার প্রতি তাকিয়ে , তৎমুহুর্তে  নিঃশব্দে এসেই তার পাশে বসলো, চক্ষু তার ছল ছল, মুখ খানা যেন মলিন হয়ে আছে।
     ভাবি দেখলো, ননদ তার পাশে বসে, অবাক হয়ে বললো, “কিরে? চোখে জল কেন? কেহ কি কোন কথা বলেছে?”  আখিরন জবাব দিলনা। কেবল নিচের দিকে চেয়ে পায়ের নখ দিয়ে মাদুর ছিড়তে লাগলো।
    ভাবি বুঝলো, এর মৌনতার মধ্যে নিশ্চয় কোনো হেতু আছে। তাই  পূনর্বার জিজ্ঞাসা করলো”এবার বলো, তোমার মন মরা কেনো? সে স্থির থাকতে পারলো না, ভাবির কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলো। ভাবি ওর ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বিস্মিত হলো,  মনে মনে ভাবলো বিয়ের কথা হয়ত শুনে থাকতে পারে, ওর চাওয়া পাওয়া ব্যর্থ হওয়ায় হয়ত এতটা ভেঙ্গে পড়েছে। “এই ভেবে শিতিল করলো” এবং বললো এই কাঁদিস কেনো?
    সে অশ্রু বিজড়িত কন্ঠে জবাব দিলো, “ভাবি” তোমার পায়ে ধরি ভাইকে বলো” আখিরন বিয়ে করবে না। ভাবি প্রত্যুত্তরে বললো তাহা কি রুপে বলবো?  বিয়ের দিন পাকা পাকি কার্যকার, একটু থেমে বললো, যা  লক্ষি “সোনা” গুরুজনদের মতের বাইরে যাওয়া দৃষ্টি কটু, আর যাহা দৃষ্টি কটু  তাহার পরিনাম ভালো না। চেয়ে দেখ ঐ নিহারিকা বিশাল আকাশে পরিদৃশ্যমান। কি একবুক ফাটা আর্তনাদন যেন আকাশে-বাতাসে-ধধ্বনিত হচ্ছে, কিন্তু এই পাষান পৃথিবীর কোনো পরিবর্তন নেই। কারন কি জানো ? এই যে নিহারিকা এই যে ভূ-মন্ডল, যাহা মানুষের সম্পুর্ন আয়াত্তের বাইরে এবং এক বিশাল শক্তি যার পিছনে কাজ করছে। সেও কিন্তু নিয়ম শৃংখলার শাষনতন্ত্রে সুনিয়ন্ত্রিত, তাহা আমি সব জানি বা বুঝি, বিয়েতে তোমার অমত কিসে? তুমি ভুল করেছো, ক্রমান্বয়ে যে উচ্চাশার পথে ধাব-বান, যার উদ্যোম রয়েছে পড়ার দিকে, তাকে ভালোবাসা ভুল। পার্থিব মোহ তার নেই, দিন দিন উন্নতির পথে অগ্রগতি। তিনি যদি তোমার রুপ, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন তবে পালিয়ে যাবে কেনো? আখিরন নিরুত্তর। আখিরন চিন্তায় মগ্ন হইল। জবাব দিবার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ভুল যখন করছি তাহা সুধরানো যাবেনা। চরন তলে লুটিয়ে না পড়লে এর কোনো বিহিত হবেনা, ভেবেই ভাবির চরণ দ্বয় ধারণ ক  বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
     ভাবি ননদের অবস্থা পর্য্যা বেক্ষন করে নিজেও অশ্রু সংবরণ করতে পারলোনা। পরিশেষে আস্বস্থ করলেন “তোর ভাইকে বিয়ে বন্ধ করতে বলব, এখন পা ছাড়।
গৃহ বধু যথা সাধ্য চেষ্টা করেও বিয়ে বন্ধ করাতে পারলোনা। আখিযরন মনে মনে সংকল্প করলো, বিয়ে যখন বন্ধ করা গেলো না তখন পোড়া মুখ কাওকে দেখাবো না।
   বিয়ের আর মাত্র দুদিন বাকি। চারিদিকে কাজ কর্মের তাড়াহুড়া পড়ে গেছে। ঘন ঘন অলংকারের বেসাতি নিয়ে বান্ধবীরা আসা যাওয়ায় এবার সোনা দানার বাহানা ধরলো।
দামী দামী রঙ বেরঙ এর শাড়ী কাপড়ের বাহানাও ধরলো। কিন্তু বাহানা ধরলোনা একমাত্র অভাগিনি এই আখিরন।  বিয়ের পূর্ব রাত্রি, চারিদিক নিঝঝুম নিস্তব্ধ। কোথাও জনমনের সাড়া শব্দ নেই এমনকি কাক কোকিলের কিচির ও নেই। সারাটা বিশ্ব যেনো নিদ্রা দেবির ক্রোড়ে মাথা রেখে ঘুমে অচেতন, কেবল জেগে আখিরন একা।
আজ মরিয়া হয়ে ঘরের দরজা খুলে দেখলো, বাড়ীর সকলেই নিদ্রিত। ধীরে ধীরে নিচে নেমে সোজা এগিয়ে চললো পল্লীর শেষ প্রান্তে ভবদহ নদীর দিকে। নদীর উপকূলে গিয়েই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। চারিদিকে চক্ষু বুলায়েই ঝপাত করে নদীগর্ভে হারিয়ে গেলো।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদঃ
    অত্র রাত্রে কিছু সংখ্যাক সমবয়সী জেেলে মালো ও মুসলমান যুবক ভবদহর নদীর পূর্ব পাড়ে বসা। জাল দড়া কোচ কালাসহ মৎস শিকারের প্রত্যাশায় সুযোগেরর জন্য সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন,কেবল মাত্র মাছ ধরার গল্প। রাত্র অধিক, সহসা নদীর অপার পাশে পানিতে কি যেনো ঝপাত করে ভারি জিনিষে শব্দ হলো। তা শুনেই আশ্চার্য হলো এত রাত্রে কি জিনিষ পড়লো? বিভিন্ন সন্তব্যর পর, জনৈক যুবক বললো” এত ঘাবড়ানোর কি আছে? নৌকা বেয়ে এগিয়ে গেলে কি হয়? তাহাতে জন দুয়েক উৎসাহী তরুণ যুবক বিদ্যুৎ বেগে নৌকা বেয়ে নদী পাড়ি দিয়ে কূলে গেলে পাড়ে কোনো কিছু পেলো না, বরং একজোড়া পাদুকা নদীর পাড়ে রয়েছে দেখলো। তাহাতে কারোর বুঝতে বাকি রইলো না, নিশ্চয় কেহ হয়ত জীবনের প্রতি মায়া ত্যাগ করে নদী পাড়ে দেহ বিষর্জন দিয়েছে এটা নিশ্চিত। এই ভেবে তাহারা উভয়ে নদীতে ডুবে ডুবে খোজা খুজি করলো, তবে কোনো কিছুই পেলো না। তথাপি তাহারা হাল ছেড়ে দেয় নাই, আরো নিচের দিকে ডুব খেতে খেতে অগ্রসর হচ্ছে। সহসা অদূরে নদীর মধ্যখানে হাতে পায়ে শেওলা জড়ানো অবস্থায় এক কিশোর বালিকা মৃত্যু প্রায় দেহ দেখে মরন কবুল করে সাতার দিয়ে নৌকা চালালো, এবং ধরমর করে নৌকায় উঠানোর পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলো সে এখনো মরে নাই, নিশ্বাস বচ্ছে। চিৎকার করে লোক জানিয়ে দিলো যে কোনো এক বালিকা আত্মহত্যার জন্য নদীতে দেহ বিষর্জন দিয়েছে, তবে এখনো মরে নাই। যথা সময়ে আধমরা কিশোরী বালিকাকে নিয়ে তাহারা তৎঘড়ি করে মালো পাড়ার পাশে অবস্থিত কুলির মার কুঁড়ে ঘরের বারান্দায় নিয়ে গেলো। সারা রাত্র অনাহারে অনিদ্রায় ডাক্তার, কবিরাজ, ফকির, বৈদ্য ডেকে ফুক ফাক ও যথোযুক্ত চিকিৎসা করলো। কুলির মার বাড়ির অনতি দূরে রশিদ শহেবের বাড়ী। সে একজন বিদ্যুৎসাহী জনদরুদী লোক, সে সমাজের একজন স্বেচ্ছা সেবক, সে আকস্মিক দুর্ঘটনার কথা তার কানে পৌছলে সে স্থির থাকতে পারলো না। তৎঘড়ি বিদ্যুৎ বেগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো।
     যথা সময়ে রোগীর কাছে আসলেই জিহ্বায় কামড় খেলো। স্ববিনয়ে বললো সেকি? এ যে, আমারই আপন চাচত শ্যালিকা” বড় ঘরের মেয়ে, কোনো কিছুর অভাব নেই। কোন দুঃখে পানিতে ডুবে আত্মবিষর্জ্জন দিচ্ছিলো? ভাবতেও পারেনি।
    দীর্ঘ চার ঘন্টা যাবত তার যথোপযুক্ত সেবা শুশ্রূষা করার পর, সংগা প্রাপ্ত হলো। তখন রশিদ সাহেব তাহাকে জজ্ঞাসা করলো, “আখিরন” তুমি কি এখন বাড়ী যেতে চাচ্ছো?  সে ঘাড় নেড়ে সায় দিল, তাহাতে তাহার সন্মতি আছে, জেনেই দ্বিমত পোষণ করলো না। তক্ষুনি তাকে গরুর গাড়ীতে চড়ায়েই রশিদ সাহেব শ্বশুর বাড়ী অভিমুখে রওনা দিলো।
    বলার অবকাশ রাখেনা, মাহমুদ সেদিন অতি প্র‍ত্যুষে ঘুম থেকে জেগেই বাহিরে যখন পা দিলো, তখন হঠাৎ করে পার্শ্বের কক্ষে তাহার দৃষ্টি পড়লো। দেখলো, ঘরের দুয়ার বন্ধ বাহিরে শিকল পরানো। এতে তাহার মহা প্রানে পানি ছিলো না। মনে মনে ভাবলো কখনও তো এত ভোরে সে ওঠেনা। আজ ওঠে কোথায় গেলো?  । মনে ভালো বললোনা, তক্ষুনি তড়ি ঘড়ি ঘরে বাহিরে আনাচ কানাচ তন্ন বিতন্ন করেও যখন তাহার পাত্তা পেলো না, তখন সে একদম হতাস। মনে স্থির করলো সে হয়ত কার হাত ধরে বাড়ীর বের হয়েছে।
     এই ভেবে নিজ কক্ষের দুয়ারে এসে স্ত্রীকে কাছে ডেকে চুপি চুপি সকল ঘটনা বলেই মাথায় হাত রেখে ভাবছে, এমন সময় গৃহকর্তৃী বললো” অত ভেঙ্গে পড়ো না, রাত্রে আহারের পর মনে হয় মেঝো বুড়ির কাছে যেতেও পারে। রাত্র অধিক হওয়াই হয়ত আসতে পারেনি, এখন চলো সেখানে গিয়ে দেখি” বলেই গৃহবধু মেঝো বুড়ির বাড়ি খানা তল্লাসি করে পেলোনা। মাহমুদ শুনেই বজ্রাঘাতের ন্যায় বসে পড়ে। গৃহ বঁধু স্বামীর হাত ধারন করে বাড়ীর অভ্যন্তরে লইবার কালে পাড়ার লোক ঝুকে আসে। এবং আভ্যন্তরীন দুঃসংবাদ শুনে তাদের মধ্যেও তৎপরতা দেখা দিলো। বেলা এক প্রহর না গড়তেই মাহমুদ  ধরাশায়ী, যেহেতু ভগ্নির নিখোজ খবর কানে না যেতেই তাহার জ্ঞান শুন্য হলো। ক্ষত নাজতেই তার চি ও স্কুৈল ঘটলো। তাহাতে মুহু মুহু মর্চ্ছাঘাত, প্রলাপ বকা শুরু করলো। সারাটা বাড়ি থম-থমে বিষাদ মাখা, আকস্মিক ভাবে মাহমুদের মস্তিষ্ক বিকৃতি। কথাটা যেমন অত্যাশ্চর্য তদ্রূপ হৃদয় বিদারক দারুণ মমর্মান্তিক ঘটনা।
    আখিরন উধাও, সহোদর ভ্রাতাও জ্ঞানহারা সংগাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। সমস্ত কাজ কর্ম অগুছানো। সকল কর্তব্য ফেলে রেখেই মাহমুদের সেবা শুশ্রূষায় সবাই তৎপর। সহসা দুলাভাই রশিদ গরুর গাড়ী নিয়ে আবাসন করলো। তাহাতে, আখিরন আধমরা অবস্থায় শায়িতা। সর্ব শরীর” সাদা ধবধবে, মনে হয় রক্তকনিকা ও অঙ্গে নাই। বাকশক্তি রহিত, সে দৃশ্য দেখেই বাড়ীতে কান্নার রোল পড়ে গেলো।  মাহমুদ স্থির থাকতে পারলো না,  তৎক্ষনাৎ তড়িত বেগে আধমরা  ভগ্নীর মুখে মুখ রেখেই ব্যক ফাঁটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
   এক্ষনে হঠাৎ করে মাষ্টারের উপস্থিতি অতি বিস্ময়কর। তাহার গলা জড়ায়ে মাহমুদ এমন ভাবে আর্তনাদ করে উঠলো, ক্রন্দনে মাষ্টারের ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটে পারলো না। একে অন্যের গলা জড়ায়ে তাহারা ক্রন্দনে সবাই কে অবাক করে দিলো। সমস্বরে কান্নার রোলে সারাটা বাড়ীতে বিষাদ সাগরের বন্যা বয়ে গেলো।
ষষ্টদশ পরিচ্ছেদঃ
    কিশোরী বয়সে আখিরনের প্রেমের পিপাসা যেগে ছিলো। যে তৃষ্ণার পরিসমাপ্তি  ঘটলো ভবধর নদীতে আত্মাহুতী দিয়ে। মনে হয়নি সে তৃষ্ণা আজও আছে। বিদায় লগ্নে বুঝলাম যে তৃষ্ণা মেটে নাই আজও আছে।
কোনো এক অশুভ ক্ষনে আজরাঈলের ভয়ংকর মূর্ত্তির বিকট ছায়া  নদী মধ্যে প্রতিফলিত। সে দৃশ্য দর্শন করে আখিরনের অন্তরাত্মা মানব দেহে ছিলো না। জ্ঞান ফেরার পর পার্থিব মোহ, মুক্তি লাভের পর বুঝলো, পুরুষ জাতটাই খারাপ। মন হরণ করতে পারে, ভালো বাসতে জানেনা। এরা নির্মম, নিষ্ঠুর।  তাদের সহিত চিবাহ বন্ধনে না হয়ে চির কাল মাতা পিতার ঘাড়ের বুঝা হয়ে থাকাটা ভালো।
     যে প্রেম কাঁচ পাত্রের ন্যায় ভেঙ্গে খান খান হবে এটা ভাবতেও পারিনি। সার্যাধিক কাল পর, সহসা খবর প্রাপ্ত হলো, বিদায়ী ছাত্ররা আজ সম্মুখস্থ পথে আসছে, গৃহ শিক্ষক আজিরও আছে সবার সাথে। কথাটা শুনেই আখিরনের চিত্তা কর্ষন করলো। তৎ ঘড়ি তার হৃদয় ভেঙ্গে গেলো। সে বুঝলো এই বুঝি তাদের চির বিচ্ছেদ। কারণ ক্ষুদ্র বিচ্ছেদ প্রেমকে দৃঢ় করে, খান স্থায়ী হলেও আখিরন-সহ তে ভেংগে- পড়ে। দ্বিত্র পাতায়, পৃষ্ঠ স্মৃতি যেন আচিকল ভেসে ওঠে। কার অঙ্কিতনে বাড়ী তিষ্ঠিতে আরে না। প্রেমের-ভরতেইর দোলায়, ধীরেই পথপ্রান্তে গিয়েই-কার প্রতিক্ষায় ১ম খন্ড (চাট বইল। আর দীর্ঘ বিচ্ছেদকে করে হত্যা। মুহুর্ত্তে তাহার চিও  পটে যেনো ভেসে ওঠে সেই প্রাতিচ্ছবি, যে স্মৃতি হৃদে এঁকে তপস্যা করতো। সে আকর্ষন রইলো না, মিটে গেছে ভবদহর নদীর মধ্যে, সমুদ্রের বিকট চেহারা দেখেই, তাহার পার্থিব মোহ ছিলোনা, সকল অতৃপ্ত কামনা ভূলে ভবদহর নদীতে অর্বগাহন করেই আখিরন যেনো আত্মসুদ্ধি লাভ করলো।
     এইক্ষনে আলেম ফাজেল পরীক্ষশ্বরী ছাত্রদের  বিদায় লগ্নে, বিদায় কথাটা অত্যান্ত মর্মান্তিক, ক্ষনস্থায়ী হলেও আখিরন-সহযে ভেঙ্গে পড়ে। চিত্র পাতায়, পূর্ব স্মৃতি যেনো অবিকল ভেসে ওঠে, কারো আকর্ষনে বাড়ী তিষ্ঠিতে পারে না। প্রেমের তরঙ্গের দোলায়, ধীরে ধীরে পথপ্রান্তে গিয়েই কারো প্রতিক্ষায় তৃষ্ণায় চেয়ে রইলো।
    একে একে সকল পরীক্ষাত্রী ছাত্র নিকটস্থ গাড়িতে স্থান আসন নিলো। কেবল মাত্র আজির এখনও গাড়িতে আসন লাভ করতে পারেনি, কেননা আখিরন প্রতিমধ্যে তাহারই সাক্ষাৎ লাভের প্রত্যাশায় দন্ডায়মান। তাহাকে কিছু না বলে যাওয়া যায় না, সেই নিমিত্তে  গমনে ক্ষান্ত দিয়েই জিজ্ঞেস করলো আখিরন তোমার শরীর কি এখন সুস্থ?
আখিরন নিরুত্তর, জবাব দিতে পারলো না, লজ্জায় মস্তকে পায়ের আঙ্গুল দ্বারা মাটি খুঁড়তে লাগলো। মাষ্টারের মাথায় বেডিং পাত্র, দাঁড়ানো দায়। পূনর্বার জবাব না দিয়ে পায়ের আঙ্গুল দ্বারা মাটি খুড়ছে। আজিরের যে দেরী সহ্য পাচ্ছেনা! জবাব না শুনলে মনও পরিতৃপ্তি হয়না। তা এখন তুমি কেমন আছো?
     আখিরন বললো, ও কথা শুনে লাভ নেই। পথিমধ্যে দাড়ায়ে, এভাবে বাক্যালাপ করা  দোষের। তথাপি মনের টানে কোনো বাধা মানলোনা। তাই ক্ষনিকের জন্য বিদায় দিতে আসলাম। মহান সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল কামনা করুক,  বলেই চোখের অশ্রু মুছে ফেললো।
    মাষ্টার আখিরনের ভাব জঙ্গি দেখে বুঝলেন, তার মনে অনেক ক্ষোপ-ব্যথা। রাস্তায় বলা সম্ভব না। সেহেতু পুনর্বার কিছু জানার প্রত্যাশা না করে কেবল বললেন “আখিরন, আমার বিলম্ব করা সম্ভব না শুভ কাজে যাচ্ছি। আল্লাহ চায়লে ফিরে এসেই শুনবো। আজির বললো আমার এই কথা, আর বিলম্ব করতে পারছিনে। গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে আসছে। আর মাত্র বিশ মিনিট বাকী, বলেই প্রস্থান করেন। সে তাহার গমন পথে একাদৃষ্টে চেয়ে রইলো। মাষ্টার দৃষ্টি পথের আড়ালে গেলেই তোকেই সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস অরিত্যাগ করে নিজ বাসায় গমন করলো।
            সপ্তদশ পরিচ্ছেদঃ
    দুর্যোগময় শীতের রাত্রে কুয়াশা ঢাকা নোংরা অন্ধকার ভেদ করে পূর্বের আকাশে দৃষ্ট হয় সুবেহ আদেকের প্রথম আলোর আভাস, কত প্রশান্ত তপস্যার পর, কি এক আশ্চর্য আশা ভরসার আশ্বাস নিয়ে আসে পাক রমজান। তাতে, ঘুমন্ত্র মানব দেহে আসে নব জাগরন। তারাবির নামাজের জামাতের জন্য কতনা তাড়াহুড়ো সবার।
    তৎকালে দুতিন গ্রাম মিলে মসজিদ। তাতে নিয়মিত ভাবে শরীক হওয়া স্বকঠিন। সেহেতু প্রতিটি পাড়ায় কিংবা মহল্লায় তারাবিহ নামাজের জামাত খাঁড়া হতো।
আজির পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফিরলো। দীর্ঘ দিন কঠোর ভ্যাগ তিতিক্ষা, সাধনা, তপস্যা করে, রাত্র জাগরনে তার দেহ মন ক্লান্ত। চক্ষু কোঠরাগত, কেহ ফিরেও চাইলো না। নিরুপায়ে সমাজের ভার সাক্ষ্য রক্ষার্থে সে তারাবিহ নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব গ্রহন করলো।
    আজ একুশে রমজান, হরিসপুর বন্ধুর বাড়ী আজিরের দাওয়াত। একদিকে সমাজের কর্তব্য অপর দিকে বন্ধুত্ব রক্ষা উভয় কর্তব্য এক রুপ। সেহেতু আরেক জনকে নামাজের-দায়িত্ব অর্পন করেই সে বন্ধুর বাড়ি গমন করলো। যথা সময়ে গন্তব্যস্থানে পৌছালে, আসরের আজান ধ্বনি তার কানে ঝংকার দিলো। কাওকে না পেয়ে নিরুপায়ে সে একাকী নামাজ সমাপন করে বসে রইলো। বৃষ্টি বাদলে ঘা খাওয়া রোদে পোড়া দেহে, বিশ্রাম পেয়েই ক্লান্ত হয়ে শয্যায় গড়া-গড়ি দিচ্ছিলো। পরিশ্রান্ত দেহখানা শয্যায় এলিয়ে না দিতেই সে নিন্দ্রা দেবির কোলে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হলো।
    ছাত্র জীবনের পড়ার সাথী বিপদ আপদের বন্ধু তরিকুল তখন বাড়ি ছিলো না, বাড়ি এসেই আজিরের আগমন খবর পেয়েই অনেক খুশি হলো। ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো অনুচিং ভেবে সে তৎঘড়ি বাজার সওদা করতে পথে বের হলো। পূর্ব বর্ণিত হুজুর নেগুড়া বাজারে যার ঔষধালয়, ইফতারের পূর্বক্ষমে খবর পাই লেন যে, মাদ্রাসার সুনাম প্রাপ্ত ছাত্র আজির তার বাস ভবনের পশ্চিম দিকে মহিলা মাদ্রাসার পাশ দিয়ে সোজা দক্ষিন দিকে গেছে। তাহা শুনতেই মুখ খানা যেনো শুকিয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলেন আমার গ্রামে পা দিয়েই কার বাড়ি যাচ্ছে কে বা তার হিতাকাংখী যে না গেলেই নয়? বিষয় গ্রামের বাহিরে কিংবা অভ্যন্তরে কোথায় কার বাড়ি গেলো? তাহা জানার জন্য তাঁর তৎপরতা দেখা গেলো।
তথ্য সংগ্রহে জানা গেলো আজির গ্রামের মাহরে কোথাও যায়নি, অত্র গ্রামের দক্ষিন আড়ায় তরিকুলদের বাড়িতে সে নিমন্ত্রিত। আজির তার পাঠ্য বন্ধু তরিকুল সম্প্রতি সংসার ধর্মে লিপ্ত। তথাপি তার আজিরের প্রতি অনুরক্ত ভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে এতটুকুও ব্যহত হয়নি।। চিরা চরিত ভাবে রোজার মধ্যে সে নিজেও গিয়েছিলো, এবং দাওয়াত ও করে আসছে। তাই বন্ধুত্ব বজায় রাখার নিমিত্তে উভয়ের মধ্যে আদান প্রদান চিরন্তন রীতি। অদ্যসে ওদের বাড়িতে এসেছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার কেহ ছাড়ে না। আজির যে হুজুরের লক্ষস্থল চিরাকাংখীত, এ খবর সে আদৌৌ রাখেনা।
    মায়ের চেয়ে যে দরদ দেখায় সে ডাইনি। কোনো হাট বাজারে দেখা হইলে তিনি নিজের পার্শ্বে তাহার স্থান দিতেন। প্রতি বৎসরে বই পুস্তক কিনে দিতেন। অযাচিত ভাবে আজিরকে সাহ্যদানের পেছনে তাহার কি যুক্তি। এতটুকু জ্ঞান আজিরের নেই। একদিন যে, ঘাড় মটকাবে সে ভাবতেও পারেনি।
     হুজুরের সুপরিকল্পিত  আশা বাস্তবে রূপ দিবার জন্য ফন্দি ফিকিরে তিনি উন্মত্ত্ব। লোলুপ জিহবা বিস্তৃত করে গ্রাস করার কৌশল তৈরী হচ্ছে, এ খবর আজির রাখেনা। বিদায় অনুষ্টানে বলেছিলো, কেন্দ্রীয় পরীক্ষার পরে একবার দেখা করবে। অদ্যবধি তাহার ছায়াও দেখলো না, তদুপরী আজ বাড়ি ডিঙ্গায়ে চলে গেলো, এতে তাহার অসহ্যকর বোধ হুলো। চোখের আড়াল হলে মনের ও আড়াল হয়, এইটা অস্বাভাবিক না। এ সব চিন্তা তাহার
হৃদয়পটে ভেষে উঠলো। তারাবিহ নামাজান্তে তাহার নিজের বাস ভবনে তরিকুলকে নিয়ে বিভিন্ন কথা বার্তার পর আপন প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেন। তাহাতে প্রকাশ করতে বাধ্য হলেন। আজিজকে লক্ষ্য করে বসে আছি যে, তাহার সাথে ভ্রাতৃ কন্যা সুফিয়াকে বিয়ে দিব, সে এখন নাগালের বাইরে, ধরা দিচ্ছেনা।  বিশ্বস্থ সূত্রে জানতে পারলাম সে নাকি তোমার বাসায়। তাহাকে যদি হাজির করাতে পারো, তবে আমার সিদ্ধি লাভের সুযোগ পাই।
তরিকুল বললো, “হুজুর” আপনি আমার শিক্ষা গুরু। আপনার কথা শীরো ধার্য্য, কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার ইচ্ছা পালন করলে বন্দুত্ব থাকেনা।
     শুজুর ——- না হয় একটু ছল চাতুরীর কৌশলে এনে দাও। পরদিন সকাল আটটার সময়, তরিকুল কর্তৃক ষড়যন্ত্র মূলক আজিরকে হুজুরের মম্মুখে আনায়ন করা হলো। ইতি পূর্বে নবাগত আজিরের আগমন বার্তা শুনেই তিনি মেয়ে দেখার পরিবেশ গড়ে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। যেহেতু আজিরকে সমাদরের সাথে নির্দিষ্টি স্থানে আসন দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
    কিছুৎক্ষন পর ঘর থেকে সুফিয়াকে বরের সম্মুখে আনায়ন করা হলো। বর পূর্ব থেকে মাথা শুজে বিনম্রভাবে বসা। মনে মনে ভাবলো, বিয়েতো করবো না! মানবতা রক্ষার্তে কন্যা না দেখলে হয়না, সেহেতু অনিচ্ছা সত্বেও মুখ উত্তোলন করে দৃষ্টি পাত করতেই চোখ ঝলখে গেলো। কি অলিন্দ সুন্দর দেহ মুখচছবি যেনো পূর্ণশশী তুল্য ঝিকিমিকি করছে। তাহা দৃষ্টি আকর্ষণীয়।
    পরক্ষনে বেহেস্তের কুঞ্জি পুস্তিকা খানি স্বহস্তে উপহার স্বরূপ কন্যার হস্তে অর্পণ করলো। কন্যাও ধীরে ধীরে গৃই মধ্যে শুবেশ করলো। নবাগত বরকে নড়া চড়া করতে দেখে গৃহকর্তা বললেন খামোশ! মতামত ব্যাক্ত না করে কিরুপে যাচ্ছো? কেতাবের কথা মুসলমানদের মতামত সামনা সামনি পাছে কথা বলা চলে না।এতে বরের “পা তুলার সাধ্য/সাহস রইলো না, বজ্রঘাতের ন্যায় বসে রইলো। মনে মনে ভাবলো, এভাবে নিশ্চুপ বসা ঠিকনা, ইহাতে অভদ্রতা প্রকাশ পায়। কিন্তু নিজের মতামত কিভাবে ব্যক্ত করি,  হ্যা ও বলতে পারছিনা আবার না ও বলতে পারছিনা, যেহেতু কন্যা কর্তার দান হলকুমে আটকানো।
  অবশেষে জবাব না দিয়ে অভিনব সুরে বললো ” হুজুর” সম্মতি থাকলেও কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ব্যক্ত করার সাধ্য নেই।
হুজুর তাহার জবাবে সন্তুষ্টি না হলেও নিরাশ হয়নি, বরের লোকেরা তাকে চেনে কেহ অচিন্ত নহে। স্থির থাকতে পারলেন না গা ঝাড়া দিয়েই দাঁড়ালেন। নবাগত আজিরের প্রতি লক্ষ করে বললেন” তোমরা থাকো, আমি না আসা পর্যন্ত এক পাও নড়বেনা। এক্ষুনি আমি অভিভাবকের অনুমতি জানতে যাচ্ছি, বলেই প্রস্থান করলেন।
অষ্টদশ পরিচ্ছেদঃ
    গোধুলি লগ্নে কোনো এক শুভক্ষনে আজির এবং সুফিয়ার শুভ বিবাহ সু-সম্পন্ন হলো। এ বিয়েতে স্বাভাবিক ভাবে যাকযমক হয়নি। অনাড়স্বরে বিনা শান শওকতে হওয়াই একদিকে মহিলাদের কৌতুক উৎসব পন্ড হয়, তাহাতে তাহারা মন ক্ষুন্ন হলো।
মাহলাদের কৌতুক উৎকর্ষ, কালন ততে, তারা মনক্ষুন্ন ইল।
    অপর দিকে কন্যার আপন ঘনিষ্ট কিছু সংখ্যাক লোকের আপত্তি, মেয়ে ছোট পাত্র মানান সই না। পঁচিশ বছর বয়স্ক যুবকের সাথে নয় বছরের কচি মেয়ে বিয়ে দেওয়া বে-মানান।
  বিবাহহ অন্তেই রব উঠলো, হুজুরের পছন্দ বোধ নেই। গাড়ি গাড়ি কেতাব পড়লেও সামাজিক জ্ঞান নেই। জ্ঞান হলে সুফিয়ার ভাগ্যে কি আধবুড়ো বর জুটতো? উত্তরের- প্রত্যাশা না করেই তাহারা একে একে মজলিশ পরিত্যাগ করলো।
    অত্র রাত্রে নবদুলহা একাকী বাসর ঘরে, বর বউ  এক শয্যায় থাকা চিরন্তন রীতি। এ ক্ষেত্রে মেয়ে যে ছোট, স্বামীর সঙ্গ কিছুই বুঝেনা সম্পূর্ণ অযোগ্য। কানা কানি শুরু হয় । অবশেষে কর্তব্যের খাতিরে সুফিয়াকে বাসর গৃহে প্রবেশ করায়েই তাহারা আত্মতৃপ্তি লাভ করলো।
     পরের দিন বিকাল বেলার কথা, প্রাচীরের বাইরে ছোট চাচার বাড়ি, বড় বাড়ির বিয়ের ঢেউ সে বাড়িতে লাগলো, তাহাতে আজির ও সুখিয়াকে কেন্দ্র করে রঙ্গের আসর গড়ে উঠলো। নবদুলহা সেখানে যেয়ে বুঝলো,  অবস্থা বেগতিক অবস্থা প্রতিকূল ভেবে ফতোয়া দিলো, এসব কার্যকলাপ জঘন্য পাপ। ইহা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ। ইহাতে অনেকেই বিরাগ, মুহূর্তে তাহাদের মুখচছবি বিষাদময় হলো। কারো সুখের ম্লান হাস্য, ক্ষনেক পরেই তাহা মিলিয়ে গেলো। এরাই কূটনীতি চালায়ে মহিলাদের উদ্বুদ্ধ করেই রঙ্গের ছিটে না দিয়েই কেহ তৃপ্তি লাভ করতে পারলো না। সাথে সাথে হাত তালি, ইহা বর্দাস্ত করবো না। পুনর্বার নীতিবাক্য ব্যয়ের প্রত্যাশা না করেই হবে দুঃখে মর্মাহত হয়ে আজির লম্বা কদমে সিংহ দ্বারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন।
     পরের দিন রজনী শেষে সেহরি খাবার সময় নিকটবর্তী, আর মাত্র ঘন্টা ক্ষানেক বাকি, দুলহার ঘুম ভেঙ্গে যায়, তখন কতনা আনন্দ তাহার মনে। একে একে কত রঙ্গীন স্বপ্ন তাহার হৃদয় পটে ভেসে ওঠে, অধৈর্য হয়ে ঘুমন্ত নববধূকে বাহুডোরে বুকে চেপে কিঞ্চিত পরম শান্তি লাভ করলেন।
     সেহরীর পর কেহ ঘুমায় নাই, উভয়ে জাগ্রত। জৈষ্ট্য মাসে আম কুড়ানোর কার কতটা উৎসাহ পুলোক তাহা বলা বলির পরিব্যক্ত করার পর আসল প্রসঙ্গ তুলে নববধুকে বললেন “সুফিয়া” মানুষ কেমন করে নীতি ভ্রষ্ট হয়? ভেবে পাইনে, যাহারা মনের খায়েশে ঘরে আটকে রেখে আমাকে তোমার সহিত বিয়ে না দিয়ে ছাড়লো না, বিয়ের আসরে তাহারা আবার কোন মুখে বলতে পারলো সুফিয়ার ভাগ্যে বুড়ো বর জুটলো, মুখে উচ্চারণ করতে লজ্জাও করলো না?
     নব বধু অবোধ মেয়ে, চার ক্লাস পর্যন্ত জ্ঞানের দৌড়। ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কি বা জবাব দেবে? তাছাড়া গাছ কাটলে গায়ে পড়ে। কইলে মা মারা যায়, না কইলে বাপে কুত্তা খায়। এতটুক সে আছেঝে, সে চেতনা তাহার । কেবল স্বামীর ব্যথা বেদনার তীব্র বাক্যে নিজেকে অন্তরে ক্ষত বিক্ষত করে নীরব ভূমিকা পালন করছে।
    নব বধু, বধুর নীরবতা দেখে তিনি পুনর্বার প্রশ্ন করলেন, “সুফিয়া” মানান সাইজ পাত্র না হয়ে বুড়ো বরই তোমার ভাগ্য প্রসন্ন করলো ইহাতে  কি তুমি সুখী? নব বধু নীরবতা ভঙ্গ করে টুপ করে ঘাড় নেড়ে সায় দিলো হ্যাঁ আমি মুখী।
     নব বধুর জবাবে স্বামীর চিত্তাকর্ষন করলো।
হৃষ্ট চিত্ত হয়ে স্বামী আনন্দের হিল্লোলে কল্লো লিত। আত্মসংযম হারা নিজকে সংযত রাখতে পারলোনা। মূহুর্তে ভেঙ্গে পড়লেন, আবেগ উল্লাসে উল্লসিত হয়েই গর্বে এক চুম্বন রেখা এঁকে দিলেন। ক্ষনেক পরে তাহার চিবুক ধরে মৃদু হাস্যে চুপে চুপে বলেন, “সুফিয়া” তুমি অল্প বয়স্কা মেয়ে হয়েও আধবুড়ো বরকে বরণ করে নিলে, তখন আমিও তোমাকে অভয় দিচ্ছি, তোমার কোনো ভয় নাই। নির্ভয়ে পড়াশুনা করে বড় হও। তোমার জীবদ্দশায় অন্য কারোর পানি গ্রহন করবোনা। একটু থেমে বললেন”  স্বামী সেবার যোগ্য না হওয়া অবধি, অসীম ধৈর্য্য ও সহননশীলতার সাথে তোমাকে গড়ে নেবো। তুমিতো জানতে পেরেছো” আমি পরের অর্থে পরের বাসায় থেকে শিক্ষা লাভ করে আসছি। দোয়া করবে, তেমনিভাবে যেনো পরের আশ্রমে থেকে প্রকৃত মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারি।
     সেহেরীর পর, বন্ধুরা ঘুমন্ত, কারোর কোনো সাড়া শব্দ নেই। কেবল মাত্র প্রভাতী পাখির কলরব শ্রুত হচ্ছে। তৎমূহুর্তে পার্শ্বে নব বধুকে ডেকে কইলেন, বিশেষ প্রয়োজনে একস্থানে আজ যাবার কথা ছিলো কিন্তু যেতে পারিনি, রাতারাতি যদি পৌছাতে পারি, তবে মূল্যায়ন হবে, নতুবা মুনাফেক কিংবা খল মানুষের পর্য্যায় ভুক্ত হয়ে কেয়ামত পর্যন্ত কু-নাম কুড়াতে হবে। তাহা কাওকে বলতে পারলাম না, কেবল তোমাকে বলে গেলাম। বলে নিমিষে সিংহদারের বহির্ভূত হলেন।
উনবিংশ পরিচ্ছদঃ
    সুফিয়ার শুভ বিবাহের পর, বর যাত্রীরা আর রইলোনা, যায়বার বেলায় তিন দিন পর কন্যাযাত্রী দাওয়াত রইলো, বর বৌ এর সাথে যাবেন। যথা সময়ে নির্দৃষ্ট তারিখে স্বয়ং বরকর্তা নিজেই গাড়ি নিয়ে আগমন করেন, তাহাতে কন্যাকর্তা স্বাগত জানালেন।
   পরের দিন এক প্রহর না গড়তেই কন্যাকর্তা পাড়ার মাথাধরা গন্যমান্যদেরকে একত্রিত করে প্রস্তাব রাখলেন যে, বরকর্তা স্বয়ং নিজেই আসছেন। কন্যা যাত্রী কতজন এবং কে কে যাবে? তাহা লিষ্টিভুক্ত করা হোক।
বড় মিঞা——– হুজুর পাড়ার সকলেই বিরাগ। সেদিন জামাই যে কান্ডটা ঘটালো, তাহাতে কারোর মান সম্মান রাখেনি, সেহেতু কন্যা যাত্রী যাওয়া যুক্তি সংগত না। তদুপরি অতি প্রত্যুষে কাওকে না বলে সে চলে গেলো! অদ্যবধি আর আসেনি। কলস রেখে জল আনতে কে কবে যায়? ঢোক চিবিয়ে —আপনার যাহা ইচ্ছা তাই করেন, আমাদের একটা গুড়োও যাবেনা। বলেই মজলিশ ভঙ্গ করলেন। একে একে সবাই স্থান ত্যাগ করলো।
    কন্যা কর্তার মাথায় বজ্রাঘাত হলো। চোখে অন্ধকার দেখছেন, কি করি আর কি হয় এর সমাধান কোথায় তাহা কিছুই স্থির করতে পারছেন না। গৃহ কর্তৃ ঘর থেকে সবই শুনছিলো, তাদের কথার ভাবে বুঝলো পরিস্থিতি ঘোলাটে। গৃহস্বামী কোনো কিছু স্থির করতে পারছেন না, তাই ভাবা চিন্তা করছেন, ইহা দেখে ধীরে ধীরে বের হয়ে স্বামীর খেদমতে এসে বললো” আকাশ ভাঙ্গা চিন্তা নিয়ে বসলে কি কোনো কাজ মেটে? অতটা ভেঙ্গে পড়বে না, বিয়ের মজলিশে যাদের মুখ দেকে বের হইছিলো, হুজুরের পছন্দবোধ নেই, নইলে কি আধবুড়ো বর সুফিয়ার ডাগ্য প্রসন্ন করতো? তাদেরই মনে অভিপ্রেত কিছু আছে। নানা ছল ছুতা করে বিয়ে ভাঙবে। নইলে নতুনেই জামায়ের দোষ অন্বেষন করতো না। কথার ভাবে বোঝা গেলো তারা সুফিয়ার কপালে দুঃখ ঘটানোর ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাহাতে, কিন্তু জাত যাবে? নিজেরই ইজ্জেত সম্মান যদি রক্ষা করতে চান, তবে সুফিয়াকে শ্বশুর বাড়ি পাঠান। তাহলে কেহ বিয়ে ভাংতে পারবে না।
গৃহস্বামী সমাজের চাপে সরাসরি কিছুই বলতে পারলেন না। পরোক্ষ ভাবে তিনি ইংগীত দিলেন। তাহাতে গৃহকর্তৃ উদ্বুদ্ধ হয়ে সুফিয়াকে বললেন” মাগো” পরের কু-মন্ত্রনায় ভেজো! তবে তোমার কপালে অশেষ দুঃখ আছে। চিরকাল মাথা কাঁটা গ্লানি তোমাকে তিলে তিলে বিদগ্ধ করবে।
   একটু থেমে——–“স্কুল মাদ্রাসার জ্ঞান পিপাষু ছেলেরা সাধারনতঃ পার্থিব মোহে পড়েনা। চিত্র জগৎ থেকে তাহারা অনেক দূরে। সে ক্ষেত্রে আজির একজন অন্যতম জ্ঞান পিপাষু উদ্যমশীল ছাত্র। তোমাকে তাহার সাথে বিয়ে দেওয়া হুজুরের দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু সে বাড়ি ঘরে ফিরে আয়ক্ষন না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করবে না। তখন সে যে কার পানি গ্রহন করবে তাহার নিশ্চয়তা নেই। লক্ষ ভ্রষ্ট হতে পারে, ভেবে তার আগেই সন্দেহ জ্ঞানার্থে বিনা আড়ম্বরে তোমাকে বিয়ে করে। আরেকটি যুক্তি শিক্ষিত পরিবারে বয়সের বৈষম্য কিছুই নৈই। তারা বরং আদর সোহাগ দিয়ে গড়ে তোলে, বরং অছে মুর্খ সমাজে এরূপ বিয়ে বেমানান। ভূত ভবিষ্যৎ কল্যান জ্ঞান মনে করে নিঃস্বন্দেহে গাড়িতে উঠে নতুন শ্বশুর বাড়ি যাও।
    ইতিপূবে সুফিয়া বাবার গৃহে  কয়েক স্বামীর সহচার্যে কালযাপন করার পর, স্বামী সোহাগের কিঞ্চিৎ  আস্বাদ লাভ করে, তাহাতে সুফিয়ার” স্বামীর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার বীজ রোপিত হয়। সেহেতু সে স্বামীর কথা সর্বক্ষন ভাবে। পাড়ায় যে ষড়যন্ত্র চলছে, সে কিছুই জানেনা, স্বভাবতঃ সে বাড়ির বের হয়না। যদিও তাহার কারো বাড়ি যাওয়া পড়ে, যেই পাকে যায়, সেই পাকে ফেরে। খেলার সাথী তার পাড়ায় নহে, সাথী বর্গ তার স্কুলে।
    বিয়ের পর সুফিয়ার জীবনে কর্মের পরিবর্তন ঘটলো। বাড়িতে থাকতে চায়না, পাড়ার সম-বয়সী মেয়েদের সঙ্গ লাভে হাস্য রসে বেড়ায়। গৃহকর্তৃী সন্দেহ জনক ভাবে সুফিয়াকে চাপ না দিয়ে ছাড়েন নি। বিনাদোষে দোষী হলেও নীরবে সহ্য করে একাকী নিঃসঙ্গতায় মাতৃ ভূমির মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে যে ধীরে ধীরে গাড়িতে আরোহন করে, প্রথম শ্বশুর বাড়ি যাত্রা করলো।
 বিংশতম পরিচ্ছেঃ
   পবিত্র রমজান মাস প্রায় শেষ, কোনো এক প্রত্যুষে সিংহের খাজুরার জামে মসজিদ মিনারা হতে ফজরের আজান সুমধুর সুরে উচ্চারিত হলো। সে আজান শুনে মুসল্লীরা একে একে মসজিদে প্রবেশ করলো। জামাত শুরু না হতেই আজিরের আবির্ভাব ঘটলো।
   যথা সময়ে জামাত শুরু হলো, তখনো তাহার
 সুন্নত নামাজ শেষ হয়নি। শেষের রাকাতে শরীক হয়ে তিনি নামাজ শেষ করলেন। মোনাজাতের পরে সকল মুসুল্লী একে একে বাড়ির দিকে গেলো, কিন্তু কেবল মাত্র নবাগত মুসল্লী আজিরের লজিং মাস্টার মাহমুদ মাহমুদ বাড়িতে গেলো না, সে একাই বসে রইলো।
    কিছুক্ষন পর আজির নামাজ থেকে বের হয়ে তাহার সাথে করমর্দন ও ছালাম বিনিময় করে আসল প্রসঙ্গ উত্থাপন করলো।
আজির এক কালে মাহমুদদের গৃহ শিক্ষক ছিলো। তাহার উপর মাহমুদের কত খাশা ভরসা, এইক্ষণে মাষ্টারের মুখে সকল বৃত্তান্ত শুনে তাহার মুখ অন্ধকার, আশার সুলে কুঠারাঘাত, তাহাতে মাষ্টারের যে ক্ষোপ প্রকাশ করেনি তাহা নহে। বরং তাহার হাত ধরে বললো, আামার ইচ্ছার বাইরে জোর পূর্বক ঘরে আটকে রেখে ধর-মার করে বৈবাহিক বন্ধনে না বেঁধে তিনি ছাড়েননি। ইহাতে ব্যক্তিগত ভাবে আমি দায়ী নই। তথাপি দায়মুক্ত হইতে এত প্রত্যুষে আসলাম। আমার কথা ছিলো ঠিক ফাজিল পরীক্ষার পর আখিরনকে বিয়ে করে বাড়ি ঘরে যাবো।
   নিয়তির কুপরিগ্রহে তার অগেই সে আশা পন্ড হয়ে গেলো। নাবলে পারিনে, কন্যা কর্তা এমন মানুষ বিচক্ষন লোক যে তিনি কর্তৃপক্ষের না জানিয়ে তিনি বিয়ের আসর করেননি।  পরক্ষনে মাষ্টার সুরটা পালটিয়ে একান্ত অনুরোধের সুর পালটিয়ে একান্ত অনুযোগের সুরে অনুমতি কামনা করে বললো, ভায়া” হতাস হবেন না। আজ সন্ধ্যার পূর্বেই যোগ্য পাত্র খুজে আনতে পারি, কেবল হুকুমের অপেক্ষা মাত্র।  মাস্টারের প্রতি মাহমুদের যে আশা. ভরসা ছিলো, তাহা ভেঙ্গে খান খান। যখন শুনলো জোর পূর্বক বিয়ের কালেমা না ঢুকায়ে শুনেনি । তখন একরুপ হতাস, ধরে মারে যে ষাট বছরের বড় সে মাষ্টারতো সেচ্ছায় বিয়েতে সম্মতি দেননি,  সেহেতু তিনি বেকছুর খালাস। তার বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ নাই। যাক সব দোষ কপালের, বলেই ললাটে ঘা দিয়ে বলতে হলো, “মাষ্টার” বেশী ক্ষুদায় ভাত জোটেনা, বড় শীতে খ্যাতা মেলে না।
     পরক্ষনে বললো, আামার একই কথা ইতিপূর্বে ভগ্নি সম্পর্কে পাড়ায় যখন মিথ্যা গুজব রটনা হচ্ছিলো, মান সম্মান রক্ষার্থে তখন কারোর অপেক্ষণ না করেই অন্যত্রে বিয়ে দিচ্ছিলাম। তাহাতে যে কতদূর বিপর্য্যয় ঘটেছে, তাহা বলার অবকাশ রাখে না। যেদিন বাড়িতে বিষাদ সিন্দুর বন্যা বয়ে গিয়েছিলো, তাহা কারোর অজানা নহে। সে করুন দৃশ্য অতি মর্মান্তিক,তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপাত্রে বিয়ে দেওয়ার সুত্রে মনের দুঃখে সে ভবদহর নদীতে ডুবে আত্মাহুতী হচ্ছিলো। ভাগ্যের জোরে মাছুরে জেলে মালোরা তাহাকে উদ্ধার করে। তার জন্য পূনর্বার বিয়ে দেওয়ার উৎসাহ কিংবা সাহস সংগতি আমার নেই। বরং তাহার সম্মতি আছে কি না তাহা তোমারই জানা প্রয়োজন।
     মাষ্টার বিরক্তবোধ করলো না, তৎঘড়ি সে আখিরনের দুয়ারে গিয়ে খাড়া, সে তখন অন্য মনস্ক ছিলো, সহসা ঘাড় ফেরায়েই আতকে উঠলো। অনেক দিন পর মাষ্টারকে নিজ কক্ষের দুয়ারে দাঁড়ানো দেখেই সে কপালটা  কুঞ্জিত করলো এবং নিরবে সে চেয়ার ছেড়ে দিলো। কেবল মাত্র”  উঠে বসুন” বলে এক পা  পিছিয়ে এসে সে স্বীয় খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে রইলো, কোনো কথাবার্তা উচ্চারণ করলো না।
     মাষ্টার এক পলকে তাহার মায়ার বাধে দৃষ্টি বুলালেন। অনুভবে বুঝলেন  এর বাড়ি সনাতন কাঠি। মনে মনে ভাবলেন আমার বিয়ের খবর যদি না শুনবে, তবে এতটা মনক্ষুন্ন কেনো হবে?
এত প্রত্যুষে কোথা থেকে আসলাম, তা তো জিজ্ঞেস করতে পারতো এই ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, ” আখিরণ” তোমার অতটা মন মরা কেনো?
    তার প্রশ্ন শুনে আখিরন তৎমূহুর্তে মাথায় হস্ত স্থাপন করে একটা চাপা নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করলো। পরক্ষনে মনের ব্যথা মনেই চেপে সঠিক জবাব না দিয়ে বললো, মাষ্টারকে মন ক্ষুন্নতার হেতু শুনে আপনার লাভ নেই । তাহাতে আপনার কল্যান ও নেই, কিংবা অকল্যান ও নেই। মনের বনে কিসের যে ফাগুন জ্বলছে তা বুঝা যাচ্ছে না।
   মাষ্টার তার মন ক্ষুন্নতার কারন জিজ্ঞেস করায়, ছাত্রী নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। তদুপরী তার বক্তব্যের শেষাংশ “মনের আগুন “কথাটা শ্রুতি গোচর হলেই তিনি মুষড়ে পড়লেন। বিক্ষিপ্ত চিন্তা তার মনের হৃদয় পটে ভেষে উঠলো “বন পুড়লে” সবাই দেখে, মন পুড়লে কেউ দেখেনা। সেহেতু মনের রোগ প্রকাশ করাও যায় না। তাহা ছাড়া নিজেও দোষী, বিধায় কোনো ক্ষোপ রইলো না। কিন্তু এত প্রত্যুষে কোথা হতে আসলাম তাহা জানার প্রয়োজন বোধ মনেও করলে না। ইহাই কি শিক্ষা শুরুর পুরস্কার।
    আখিরন”  মাষ্টারের চিন্তা মগ্নভাব দেখে বিস্মিত হাস্যে জবাবে বললো, “অতটা ভেঙ্গে পড়লেন কেনো ? বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস  করেন, আমি মাঝে মাঝে পড়তে যেতাম না।খেলার সাথীদের সাথে বিচিত্র দৃশ্য দেখে চক্ষু জুড়াতাম, তাহা কি যেতে দেতেন? ছলে বলে কলে কৌশলে বাঁধা ধরা আনের শিকল পরায়ে রাখতেন, চোখের আড়ালল হতে দেননি। ইহা নিশ্চিৎ সত্য কথা, তাহাতে অবাধে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে হৃদয় জুড়ে আপনার স্মৃতি এঁকে কল্পনার তলি দ্বারা আকাশের তারকাগনে বিনা সুতার মালা গেথেছি। কিছু  দিন পর ঘটনা চক্রে নির্লজ্জায় আপনাকে বলছিলাম, মাষ্টার” একটিবার বলুন “আখিরন” তুমি আমআর, আমি তোমাকই ” তার পরি উত্তরে আপনার সমর্থন ছিলো না? তাই যদি সত্য হয় তবে ভেঙ্গে পড়ার কারণ কারণ নেই, যদিও আপনি কথা রক্ষা করতে পারেননি। ইহাতে কোনোদিন অভিযুক্ত হবোনা। অল্প শোকে কাতর, বিস্তর শোকে পাথর। সকল কামনা আমার ভবদহর নদী জলে মিটে গেছে। আজ থেকে আপনার প্রতি আমার অভিযোগ নেই।
    মাষ্টার তার সকল কথা শুনে বুঝে বলেন ” আখিরন” জানলাম বেকছুর খালাস। তবে একটি কথা, যদি আমার কাছে কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকো, তাহলে আমি তোমার শিক্ষা গুরু। সে ক্ষেত্রে আমার একটি দাবি, আমি যেমন অনিচ্ছায় বিবাহে সম্মতি না দিয়ে পারেনি, তোমাকেও বলছি, অনিচ্ছা সত্তেও বিবাহ সুত্রে আবদ্ধ হয়ে সংসার পেতে বাস করতে হবে” বলেই তার দক্ষিন হস্ত ধারন করেন। একান্ত অনুযোগের সুরে বলতে যাবে, এমন সময় সে নিজের হস্ত মুক্ত করলো। ইহাতে তিনি মর্মাহত হয়ে পড়লেন। নিজকে সামলিয়ে নিয়ে পূনর্বার বললেন “তাহলে আমাকে বেয়াকুপ করে দিবে?
    আখিরণ কিছুক্ষণ নীরবতায় থাকে। পরক্ষনে পূর্ব স্মৃতি তার দৃষ্টি পথে পরিদৃষ্ট হয়।মরা দেহে যেনো প্রাণের সঞ্চার। তাই নিজ মূর্তি ধার না করে পারলো না। রুক্ষস্বরে জবাব দিলো” আপনি কি চান ? পৃথিবীতে কিছু কি কারোর প্রার্থনীয় নেই? ধন সম্পদ, মান সন্মান, রঙ্গ রহস্য, পৃথিবীতে যাহাকে সুখ বলে, সবই দিবো, বিনিময়ে কিছু তাহার প্রতিদান চাহিনে। কেবল আপনার সাথী হতে চাই। আপনার যে বৌ হবো, এগৌরব চাইনে।
    কাতর কণ্ঠে তাহা স্বকরুন আবেদন শুনেও মাষ্টারের মন গললোনা। তিনি দৃঢ় সংকল্পে  অটল। তাহার করনীয় কিছুই নেই যেহেতু সে গরীবের ছেলে নিজেই শুতে জায়গা পায়না, আবার শংকরকে ডাকে। একেত এক বৌয়ের ভরন পোষন দেওয়া স্ব-কঠিন, তদুপরী আরেক চাপ, ইহা কখনও গ্রহণ যোগ্য না। এই মর্মে তাহাকে বললো, ” আখিরন” নিস্ব দরিদ্রের সন্তান আমি, অতটা সুখ ভোগোর প্রত্যাশা করি না। ইহ জন্মে ছোট হয়ে, গরীবানা ভাবে জীবন কাটাতে চাই, তোমার দত্ত ধন সম্পদ নিয়ে সুখী হতে চাইনা।
    আখিরন নিরুপায়ে বললো, “ভালো, সে যাই হোক, সৃষ্টি কর্তার যদি সেই ইচ্ছা হয় তবে চিত্ত বিত্ত সকল অতল জলে ডুবাইবো, আর কিছু চাইনা। আরো অনেকবার এ পথে আসবেন, দোষী ভেবে মাঝে মাঝে দেখা দিবেন, কেবল চক্ষু পরিতৃপ্তি করতে ইচ্ছুক।
   আখিরনের অশ্রুভরা চোখে তাহার আত্মাহুতীর বেদনা দেখে মাষ্টারের দৃঢ়তার ভাঙ্গন ধরলো, স্থির থাকতে পারলেন না। সহসা তাহার পাশে গিয়েই শীরে হস্ত সঞ্চালন করতে করতে কাতর কন্ঠে বললেন, আখিরন” দুধের স্বাদ না মিটলেও বাহিরের জগৎ দেখো। নেই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো” ঢোক গিলে বললেন” জানি আমাকে তুমি প্রানপোন ভালো বাসো।  যাহার আশাপথে চেয়ে বিনা সুতার মালা গাঁত্তছো” কুটনীতির খপ্পরে পড়ে বিয়ের সময় পৌছানোর আগেই তাহাকে আরেকজন অবলা বালিকার পানি গ্রহন না করে কিছুতেই ছাড়েনি, সেহেতু সে পথে কাঁটা। তাই বলি” কথা রাখো আমি তোমার শিক্ষাগুরু, বিষন্ন চিত্তে ফিরিয়ে দিওনা। কথা দিলাম আশানুরুপ বরেন্য না হলে সে পথে যাবো না। আখিরন” একবার আমার কথার সায় দাও।
     প্রিয়জনের হস্ত পাশে আখিরন পরশ পাথরের ছোয়াচ তুল্য মোমের ন্যায় ক্রমান্বয়ে বিগলিত হলো। নিমিষে তাহার অন্তর্দাহর অবসান ঘটলো। সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে নমনীয় ভাব ফুটে উঠলো। নিমিষের মধ্যে তাহার সকল ক্ষোপ দুঃখ, মর্মব্যথা, চোখের জলে ভাসিয়েই স্বস্তি লাভ করলো। রাগ দেষ হিংসা তাহার ধুয়ে মুছে গেলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাষ ত্যগ করার পর, সে নিরুপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *