ভূল শুধুই ভূল
মুহাঃ মোশাররফ হোসেনঃ
দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন তুমি যদি কোনো ভূল করে থাকো এবং সেটিকে সংশোধন না করো তাহলে সেটিই হচ্ছে জীবনের সব চেয়ে বড় ভূল।
আসলে ভুল করা প্রতিটি মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ভূল প্রত্যেকটা মানূষ করে থাকে, কারন আমাদের আদি মানব পিতা হযরত আদম এবং মা হাওয়া আঃ ভূল করেছেন, আর ভূল দিয়েই মানূষের সৃষ্টি, মানুষ শব্দের আরবি হলো নাস, যাহার আভিধানিক অর্থ হলো ভূল, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যিনি ভুল করেন নি। এই ভুল করাকে আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। যার ফলে প্রবাদ-ই দাঁড়িয়ে গেছে যে, মানুষ মাত্রই ভুল করে (Only humans make mistakes)।
আমরা গানও শুনি এরকম যে, ‘ভুল সবই ভুল, তার পর ভূল বুঝিয়া যদি ভূলে যাও মোরে, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা আছে তাহা সবই ভুল’। এভাবে ভুলকে মেনে নিয়ে আমরা ভুলের বৃত্তে আটকে আছি।
জীবন চলার পথে বিভিন্ন সময়ে আমরা ভূল করছি। আর এই একই ভূল বার বার করার পেছনে দায়ী মূলত আমাদের অসচেতনতা, যেমনটা করেছিলো বাবা আদম এবং মা হাওয়া, কারন আল্লাহর নিষেধ সত্যেও গন্ধপ খেয়েছিলো, যেটা আল্লাহর নিষেধ ছিলো, এ সব এর পিছনে কাজ করে শয়তানের প্রবঞ্চনা ও অসচেতনতা, আর ভূলের কারনেই আজ আমরা দুনিয়াই এসেছি, নইলে আনরা বেহেস্তেই থাকতাম। ভূল আমাদের যেহেতু প্রথম থেকেই আল্লাহর ইশারায় হয়ে আসছে, তাই ভূলকে আমাদের মেনে নিয়েই সচেতনতার সাথে সামনে এগুতে হবে।
এই অসচেতনতার বৃত্ত থেকে বের হয়ে এসে আমরা যেনো আমাদের জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে পারি। আমরা প্রতিনিয়ত ভূল করি কিন্তু ভুলটাকে সহজে স্বীকার করতে চাই না, কারণ আমাদের অবচেতন মনের অহমিকার কারণে। ভূল স্বীকার না করে আমরা বরং বিষয়টিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি। এর ফলে আমরা ভূলটাকে আর বুঝতে পারি না, ভূলের মধ্যেই আমরা বাস করি। তখন সহজ-সরল জীবনটা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে যায়।
আমরা অনেক সময়ই একটা প্রবাদ বলে থাকি যে, ‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়’ অর্থাৎ মানুষ একবার ভূল করলে আর ঐ পথে যায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে, মানুষ সাধারণভাবে একই ভূলই বার বার করে।
আমরা ভূলের ক্ষেত্রেও নতুন কোনো ভূল করতে পারি না। দেখবেন, যে রাগী সে হয়তো একটি ব্যাপার ঘুরে ফিরে একইভাবে রাগ করে। যেমন- সন্তান জানে যে, মা-বাবা কোন বিষয়টিতে বেশি রাগ করেন। হয়তো সেই ঘটনাটিই সে বার বার করে, যাতে তারা ক্ষেপেন।
বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই পরীক্ষার আগে প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! এই বার কোনো রকমে পাস করিয়ে দাও, এমন ভূল আর করবো না। পরের বার সব পড়া আগেই শেষ করে রাখবো, আর ফাঁকি দেবো না, সময় নষ্ট করবো না। কিন্তু পরীক্ষা শেষ! পরের পরীক্ষার আগে আবার একই ঘটনা।
আমরা কি করি- রোজ ভাবি কালকে সকালবেলা ঠিক সময় মতো ঘুম থেকে উঠবো, নামাজ পড়বো, ব্যায়াম করবো। এরপর কি হয়? এলার্ম বাজে আমরা এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে আবার ঘুমাই। অর্থাৎ আমরা ভূল সংশোধন করার বদলে ভূলের পুনরাবৃত্তিই করি, ভূলের বৃত্তে ঘুরপাক খাই।
আসলে একই ভূল বার বার করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। আহাম্মকেরাই একই ভূল বার বার করে, আর জ্ঞানীরা ভূল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বা সংশোধনের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায়।
আসলে ভুল করা যতটা দোষের ভুলের পুনরাবৃত্তি তার চেয়ে বেশি দোষের। যতক্ষণ না নিজের ভিতর থেকে অভ্যাসটাকে বদলাতে পারবেন, ততক্ষণ আপনার দুর্দশা কেউ ঘোচাতে পারবে না।
ভুল ছোট বা বড় সব ব্যাপারেই সচেতন হতে হবে।
অনেক সময় ছোট ছোট ভুলগুলোকে অবহেলা করতে করতেই আমরা বড় ভূল করে বড় গর্তে পড়ে যাই। একটা ছোট্ট ছিদ্রই কিন্তু একটা বিশাল জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম। কলস যদি ছিদ্র থাকে, আর পানি এনে সেই কলসে যদি রেখে দেওয়ার চেষ্টা করি তাহলে কলসেতো পানি দাঁড়াবে না, কারন কলসতো ছিদ্র যতক্ষন না আপনি কলসটির ছিদ্র করবেন।
যেমন গ্যাংগ্রিন হয় ছোট্ট একটা কাটা থেকে। ছোট্ট একটা সিগারেটের টানই একজন ধূমপায়ীর জীবনে আসক্তির প্রথম পদক্ষেপ। আর ছোট্ট একটা সিগারেটের কারণেই মানূষের হয় ক্যান্সার, আর এই ক্যান্সারের কারনেই হায়াত থাকতেও হায়াত থাকে না, মানুষকে মৃত্যুর কোলে ডেলে পড়তে হয়।
আবার যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখবো সম্রাট জাহাঙ্গীর তার কন্যার রোগ নিরাময় লাভের বিনিময়ে ব্রিটিশ চিকিৎসককে উপহারস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিনা মাশুলে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এর পরিণতিতে পুরো জাতিকে ২০০ বছরের পরাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে হয়েছিলো।
আমাদের পারিবারিক জীবনেও যে অশান্তি, কলহ বা ঝগড়ার সূত্রপাত তা হয়তো খুব সাধারণ, ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে হয়ে থাকে, আমরা এই ছোট্ট ছোট্ট বিষয় গুলোকে বড় করে দেখে তার থেকে দূরে সরে আসার চেষ্ঠা করি দেখবেন আস্তে আস্তে সব ভূলই কম হতে থাকবে।
অনেক সময় আমরা অপরপক্ষকে সেন্টিমেন্টে আঘাত করে কথা বলি, যা আমাদের পরস্পরের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। ছোট্ট একটা বিষয় থেকে বিরাট কলহ, এমনকি বিচ্ছেদেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অতএব ছোট ছোট ভুলগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সংশোধনের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে, সচেতন হতে হবে। ভুল আসলে মানুষের জীবনে থাকবেই। রাতা রাতি সবকিছু বদলে যাওয়া যায় না। তাকে সময় দিতে হবে, চেষ্টা করতে হবে। তবে আন্তরিক চেষ্টা করলে আস্তে আস্তে ভুলের পরিমাণ কমতে থাকবে।
ভুল না করার ব্যাপারে সব চেয়ে প্রথম কাজ হলো সচেতন হতে হবে, এবং সকল মন-স্থির করে করতে হবে। তবে অতীত ভুলকে বার বার মনে করে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় পাপবোধ অর্থাৎ অহেতুক অনুশোচনা যেনো আমরা বেশি বেশি না করি।
ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়ে গেলেও হতাশ হওয়া যাবে না। বার বার চেষ্টা করতে হবে ভুলের গতি প্রকৃতি বিচার বিশ্লেষণ করে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একবার বলেছিলেন- ‘মানুষের সাফল্য সবটুকু করতে পারে না, সাধ্যমতো করতে পারায়। সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে, সেটাই স্রষ্টা দেখবেন, সাধ্যের বাহিরে কিছু করা ঠিক নই ইংরেজি এক প্রবাদ আছে যে Exess of anything is very bad অর্থাৎ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ভালো নই।
আসলে নিজের ভুলের জন্যে স্রষ্টার কাছ থেকে ক্ষমা পেতে চাইলে অন্যের ভুলকে ক্ষমা করা শিখতে হবে আগে, যতবার অন্যকে ক্ষমা করবে, ততবার স্রষ্টার কাছ থেকে ক্ষমা পাইবে। প্রাকৃতিক নিয়মেই তখন ভুলের পরিমাণ কমতে থাকবে।
নিজের কাজের জন্যে বা নিজের ভুলের জন্যে নিজের কাছে জবাবদিহিতা হলো ভুল কমাবার সবচেয়ে ফলপ্রসূ প্রক্রিয়া। আপনি প্রতিদিন কাজ শেষে রাতে ঘুমানোর পূর্বে নিজের কাজের আত্বসমালোচনা করবেন দেখবেন সব ভূল আস্তে আস্তে কমে যাবে।
আসলে বুদ্ধিমান মানুষ সবসময় নিজের ভুল বুঝতে পারেন, এবং সেই ভূলকে সে শুদরাবার চেষ্টা করে, এবং সে সফলতাও পাই।
দেখা যাচ্ছে যে, অস্থির অবস্থায়ই মানুষ বেশি ভুল করে। কাজে মনোযোগ না থাকলে কোনো কাজই সুশৃঙ্খলভাবে সঠিক উপায়ে করা যায় না। স্থির থাকলে সব কাজই সুন্দরভাবে করা যায়, যেকোনো অবস্থায় রি-এক্ট না করে, ধীর স্থীরভাবে বিষয়টি সমাধান করা যায়।
যখন একজন মানুষ একটু সু-স্থির হতে পারে, নীরবে চিন্তা করতে পারে, তখন সে মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে পারে, এবং সমাধানের নতুন পথ পেয়ে যায়। একমাত্র মেডিটেশন বা ধ্যান বা প্রানায়াম পারে আপনাকে স্থির করতে। ফলে আপনার কাজের গতি বাড়াবে, মনোসংযোগ বাড়াবে, কাজে পর্যালোচনাও বাড়বে নিয়মিত, সেই সাথে ভুলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে জীবনের প্রশান্ত অনুভূতিতে সিক্ত হতে পারবেন।
স্রষ্টা আমাদের সকলকেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুলের বৃত্ত ভাঙ্গার সুযোগ করে দিন। (আমিন)