বিশ্ব নবীর চরিত্র ও বৈশিষঠ্যঃ
মুহাঃ মোশাররফ হোসেনঃ
মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মোহম্মদ (সাঃ) ছিলেন উত্তম চরিত্রে অধিকারি। তার চরিত্র ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের। কোন মানুষ তার সমকক্ষ হওয়া তো দুরের কথা তার কোন একটি গুণাবলীর সমানও হতে পারবে না। তাকে যিনি শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি হলেন স্বয়ং মহান প্রভু আল্লাহ্ তায়ালা। একদা হযরত আয়শা রাঃ এর নকট এক সাহাবী রাসুল সাঃ এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে প্রতিউত্তরে আয়শা রাঃ বললেন তোমরা কুর-আন দেখেছো? কুর-আনের মতই তোমাদের রাসুলের চরিত্র। এ থেকেও বুঝা যায় রাসুল সাঃ এর তুলনা পৃথবীর অন্য কারোর মত নই।
ইসলাম র্ধম প্রচারের পাশাপাশি ইহুদী খৃষ্ঠানরা পারিশক, প্রভৃতি তৎকালীন জাতিসমূহের ধর্ম-সংস্কার ও আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ করেছিলেন রাসূল সাঃ। অবসর সময়ে হযরত মেষ চরাতেন। মেষ চারণের সঙ্গে পয়গম্বরগণের জীবনের এক আশ্চর্য সম্বদ্ধ দেখা যায়।
অধিকাংশ পয়গম্বরগণ মেষ চালক ছিলেন। উন্মুক্ত লীল আকাশের তলে বিশাল প্রন্তরে একপাল মেষ আর তার একজন চালক। কোন মেষ যাতে বিপথগামী না হয়। অপরের শস্যক্ষেত্র নষ্ট না করে বাঘে না ধরে, অথচ প্রত্যেকেই উপযুক্ত আহার পাইয়া হুষ্টপুষ্ট হইয়া সন্ধ্যকালে প্রভুর গৃহে নির্বিঘ্নে ফিরে আসে। এটা থাকে মেষ চালকের প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্যের সঙ্গে পয়গম্বরগণের জীবনের কর্তব্য ও লক্ষ্যের মিল রয়েছে। পয়গম্বর হলো একটা জাতির পরিচালক।
মেষ চালকের মতো তিনিও নর-চালক। খোদার বান্ধার পিছয়ে থাকিয়ে তিনি সুপথে পরিচালনা করে ইহলোকের ও পরলোকের খোরাক যোগায়া পরিপুষ্টি অবস্থায় সকালকে প্রভুর গৃহে সঠিক ভাবে পৌঁছে দেওয়াই তাদের মূল কর্তব্য। আর সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হযরত মোহম্মদ (সাঃ)। কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী। (সুরা আল ক্বালামঃ ৪) অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, আর আপনি আমার চোখে চোখেই আছেন। (সুরা তুরঃ ৪৮)
রাসুল (সাঃ) এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যঃ
১। ধৈর্যঃ নিজেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্বদা আল্লাহ্ তায়ালার আনুগত্যের উপর অটল রাখা, অবাধ্যতার নিকটবর্তী না হওয়া, তার সিদ্ধান্তের কারণে হা হুতাশ না করা এবং তাতে রাগান্বিত না হওয়ার নামই ধৈর্য। রাসুল (সাঃ) ইসলামের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করতে গিয়ে কুরাইশদের কাছ থেকে অমানুষিকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ধৈর্যধারণ করেছেন।
তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন দুঃখের বছর, যুদ্ধক্ষেত্র, ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, ক্ষুধা ও অন্যান্য পরিস্থিতিতে। কোন ষড়যন্ত্রই তাকে দুর্বল করতে পারেনি এবং কোন পক্ষই তাকে টলাতে পারেনি।
২। ক্ষমা করাঃ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নেয়ার নামই ক্ষমা। মক্কা বিজয়ের দিনে রাসুল(সাঃ)মক্কার লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন। তারা নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে তার নির্দেশেরই অপেক্ষা করছিল। তিনি বললেন: হে কুরাইশগণ তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা করো? তারা বললোঃ সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মত, তিনি বললেন: তোমরা চলে যাও !!! আজ তোমরা মুক্ত!!! তারা তাকে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন, তিরস্কার, সামাজিকভাবে বয়কট করা এমনকি হত্যার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। এর নামই ক্ষমা!
৩। সাহসীকতাঃ কথাবার্তা, মতপ্রকাশ ও কোন কাজ করতে যাওয়ায় সাহসীকতা প্রদর্শন একটা অত্যন্ত চমৎকার গুণাবলী। রাসুল (সাঃ) যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন সকল মানুষের চেয়ে বেশী সাহসী। তার মত সাহসী মানুষ কোন চোখ দেখেনি। বীর সিপাহী হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ যখন প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হত তখন আমরা রাসুল (সাঃ) কে আড়াল নিয়ে আত্মরক্ষা করতাম। তিনি থাকতেন আমাদের মধ্য থেকে শত্রুদের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে উহুদ ও হুনায়ন যুদ্ধে।
৫। দানশীলতাঃ মুহাম্মাদ (সাঃ) এর দানশীলতা ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। তিনি নিজের কাছে কিছু থাকলে কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি একসময় ইয়েমেনী এক সেট পোশাক পরেছিলেন। একজন এসে পোশাকটা চাইলে তিনি বাড়ীতে গিয়ে সেটা খুলে ফেললেন। এরপর সেটা লোকটির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তার কাছে কেউ কিছু চাইলেই তিনি তা দিয়ে দিতেন। একবার একজন লোক তার কাছে এসে ছাগল চাইলে তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণ ছাগল দিয়েছিলেন। যা দুই পাহাড়ের মধ্যকার স্থান পূর্ণ করে ফেলবে।এরপর লোকটা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে বললীঃ হে আমার সম্প্রদায় তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। আল্লাহর কসম !! মুহাম্মাদ(সাঃ) এত বেশী পরিমাণে দান করেন যে কখনও দারিদ্রতার ভয় করেন না।
হযরত মুসা বিন আনাস (রাঃ)হতে বর্ণিত, তিনি তার পিতার সুত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সাঃ) এর ক্ষেত্রে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি যে, কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছে অথচ, তিনি তা দেননি। তিনি বলেনঃ একবার তার কাছে একজন লোক আসলো এবং ছাগল চসিলো। তিনি তাকে এত বেশী পরিমাণ ছাগল দিয়ে দিলেন যা দুই পাহাড়ের মধ্যস্থান পরিপূর্ণ করে দেবে। অতঃপর লোকটি নিজের সম্প্রদায়কে বলল: হে আমার সম্প্রদায়!! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কেননা, মুহাম্মদ (সাঃ) এত বেশী পরিমাণে দান করছেন যে তিনি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কোন ভয় করেন না। (মুসলিম শরীফ-২৩১২)
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, লোকটি রাসুল (সাঃ) এর কাছে শুধুমাত্র দুনিয়াবী স্বার্থের জন্যই এসেছিল। কিন্তু, সন্ধাবেলা এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, রাসুল (সাঃ)এর আনীত দ্বীন উক্ত ব্যক্তির কাছে পৃথিবী ও তার মধ্যকার সমস্ত জিনিসের চেয়ে বেশী প্রিয় ও সম্মানিত বলে গণ্য হলো। (মুসনাদে আহমাদ-১৪০২৯;হাদীসটি সহীহ)
৬। ন্যায়বিচারঃ রাসুল (সাঃ) এর ন্যায় বিচারের অনেক প্রমাণ রয়েছে। তন্মধ্যে এখানে মাখজুমী গোত্রের একজন মহিলার ঘটনা উল্লেখ করবো। চুরির কারণে তার উপর শাস্তিস্বরূপ হাত কাটার বিধান বাস্তবায়ন করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কেননা, মহিলা ছিলো উচ্চ বংশীয় লোক। সাহাবীগণ তার ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য রাসুল (সাঃ) এর কাছে তার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হযরত উসামা (রাঃ) কে পাঠিয়ে দিলেন।
৭। লজ্জাশীলতাঃ হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) বলেন: ঘরের ভিতরে অবস্থানকারিনী কুমারী মেয়ের চেয়েও রাসুল(সাঃ) বেশী লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি কোন কিছু দেখে অপছন্দ করতেন তখন তার চেহারা দেখেই আমরা বুঝতে পারতাম। (বুখারী-৬১০২, ৩৫৬২, ৬১১৯।
তথ্য সংগ্রহঃ
১. মাদ্রাসায় লেখা পড়া জীবনের বিভিন্ন বই, ধর্ম থেকে।
২. বিশ্ব নবী বই থেকে (লেখক গোলাম মোস্তফা)।