বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৭ই মার্চকে নিয়ে কিছু ইতি কথা
মুহাঃ মোশাররফ হোসেন
১৭ই মার্চ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মদিন। বাংলার স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
বাংলার রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন।
বাঙ্গালি জাতির মুক্তির জন্য তিনি নিজের জীবনকে উৎস্বর্গ করেছিলেন। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ পেরিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন তিনি।
প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশিক শ্বাসন শোষণ থেকে স্বাধীনতার জন্য উত্তাল ভারতের অগ্নিগর্ভে জন্ম নেন শেখ মুজিব। পরাধীন ভারতে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিব শৈশব থেকেই জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতন দেখেছেন। মানুষের দুঃখো, কষ্ট দেখে তাদের মুক্তির সংগ্রামে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নিজের জীবনকে উৎস্বর্গ করেছিলেন।
ব্রিটিশ শ্বাসন ও শোষণের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত হলেও বাঙ্গালির ওপর জেঁকে বসে পাকিস্তানি উপনিবেশিক শ্বাসন-শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন। ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র শুরু থেকেই বাঙ্গালির ওপর নির্যাতনের স্টিম বুলড্রেজার রোলার চালাতে থাকে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তখন থেকেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে বাঙ্গালি। ছাত্রজীবন থেকেই বাঙ্গালির মুক্তির আন্দোলনে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করে। ধারাবাহিক পথ পেরিয়ে শেখ মুজিব বাঙ্গালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। একাত্তরের ৭ই মার্চ তিনি ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙ্গালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াতে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকো, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো...’। বঙ্গবন্ধুর এই চূড়ান্ত নির্দেশই জাতিকে স্বশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস জোগায়।
চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন তিনি এবং এই কলেজের বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে শেখ মুজিব বিএ পাস করেন। তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি হোসেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শান্তি স্থাপনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসম সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে স্বক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শেখ মুজিব।
ভ্রান্ত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্না উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ তথা বাঙ্গালি জাতি প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, এবং আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নেমে আসে অত্যাচার জেল-জুলুম নির্যাতন।
রাজনৈতিক জীবনে এক যুগেরও অধিককাল তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। দুইবার তিনি ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, ১৮ বার কারাবরণ করেছেন। পাকিস্তাানি শ্বাসক চক্রের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করেছেন। ’১৯৫২, ’১৯৫৪, ’১৯৬২, ’১৯৬৬- এর আন্দোলন আর ’১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ’১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয় সবই জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের একেকটি মাইলফলক। আর এই সংগ্রামের নেতৃত্ব ও বলিষ্ঠ ভূমিকায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৯- এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে বাংলা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসেন। তিনি বাঙ্গালির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্থাৎ দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় মানবতার শত্রু, স্বাধীনতা বিরোধী, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ঘাতক চক্ররা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করে।