গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহি পালকি
মুহাঃ মোশাররফ হোসেনঃ
গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী পালকি। আধুনিকতার ছোয়ায় এখন বিয়ে করে বৌ’রা মাইক্রো-কার এ শ্বশুর বাড়ি যায়। আর পালকিতে তারা যায় না। এখন আর চোখে দেখা যায় না সেই ঐতিহ্যবাহি পালকি। এই পালকি যেনো রূপ-কথার কল্প কাহিনী হয়ে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তির যানবাহনের যুগে হারিয়ে গেছে হাজার বছরের গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ‘পালকি' গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পালকি এখন আর দেখা যায় না। এক সময় গ্রামের বিয়ের বর-বধুকে বাহনের অন্যতম বাহন ছিলো পালকি।
বাংলার সবুজ শ্যামল মেঠো পথের এক সময়ের নিত্য দিনের বাহন ছিলো পালকি। পালকির সঙ্গে মিশে ছিলো মধুময় এক স্বপ্ন। গায়ের পথে পালকি করে নববধুকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় আর বৌ-ঝিয়েরা বাড়ির ভিতর থেকে উঁকি-ঝুঁকি মারতো।
পালকির মধ্যে বসা বৌকে দেখে তারাও হারিয়ে যেতো কল্পনার রাজ্যে। ছয় বেয়ারা পালকি কাঁদে নিয়ে ছন্দ তুলে বৌকে নিয়ে বাংলার শ্যামল মেঠো পথে চলতো। তখন গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য্য অনেক বেড়ে যেতো। সাজানো-গোছানো পালকি করে আগের-কার দিনে নব-বধু বাপের বাড়ি যেতো। এ যুগের বধুরা আর পালকিতে লজ্জা রাঙ্গা মুখে শ্বশুর বাড়ি যায় না। আমাদের সেই শ্যামল বাংলা, সেই মেঠো পথ, নতুন বধু সবই আছে কিন্তু যান্ত্রিক যুগে শুধু নেই কেবল পালকি!
পালকির ব্যবহার কিভাবে কখন এদেশে শুরু হয়েছিলো তা সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে মোঘল ও পাঠান আমলে বাদশাহ, সুলতান, বেগম ও শাহাজাদীরা পালকিতে যাতায়াত করতো বলে জানা যায়। ইংরেজ আমলের নীলকররা পালকিতে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতো বলে জানা যায়। আর সেজন্যই পালকি অভিজাত শ্রেণীর বাহন হিসেবে গন্য করা হতো। পালকি দেখতে অনেকটা কাঠের বােরে কাঠামো। দৈর্ঘ্য ৬ ফুট প্রস্থে তার অর্ধেক কাঠামোটি লম্বা দুপাশে বাঁশের সাহায্যে গাঁথা। পালকির উপরে দামী কাপড় দ্বারা মোড়ানো থাকতো।
তৎকালীন বাঙ্গালির সংস্কৃতিতে পালকির অবস্থান ছিলো সুদৃঢ়। আগের দিনে বিত্তশালী পরিবার গুলোতে নিজস্ব পালকি ও বেয়ারা থাকতো। আর নিম্নবিত্তরা তাদের বৌ-ঝিদের আনা নেয়ার জন্য ভাড়া করতো পালকি। অন্যসব কাজে পালকি ব্যবহার হলেও বিয়ে-সাদিতে পালকির ব্যবহার ছিলো অপরিহার্য্য। নববধুকে নিয়ে বেয়ারারা নানা সুখ-দুুঃখের গান গেয়ে দুলকি তালে চলতো পালকি।
বিবর্তনের ধারায় সব কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে বর্তমানে রাজা, বাদশা নেই, তাই পালকি ও বেয়ারাও নেই। বর্তমান যুগের নববধুরা পালকিতে চড়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন দেখে না। তারা জাকজমক ভাবে সাজানো প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসে চড়ে শ্বশুর বাড়ি যায়। তবে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের নতুন প্রজন্মরা পালকি নামক মানুষের ঘাড়ে চড়ে বসা কোন বাহনের কথা বই প্রস্তকে পড়বে এবং লোক শিল্প যাদুঘরে গিয়ে সাজানো গোছানো কৃত্রিম পালকি দেখবে। যশোর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে আগের দিনে পালকির প্রচলন ছিলো।
গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও বিয়েতে অন্যতম বাহন ছিলো পালকি। পালকি উপজেলার কোথাও এখন আর দেখা যায় না। বর্তমানে পালকির প্রচলন না থাকায় এ পেশার সাথে জড়িতরা জীবন-জীবিকার তাগিদে অন্যান্য পেশা বেছে নিয়েছে।